বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ: শূন্যপূরাণ এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য

চর্যাপদ আবিষ্কারের পূর্বে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের শুরুটাই প্রাচীন যুগ হিসেবে বিবেচিত হত। বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা মধ্যযুগের প্রাথমিক সীমা নির্দেশ করে। দ্বাদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী অর্থাৎ মুসলমান রাজত্বকালে রচিত সাহিত্যকে মধ্যযুগের সাহিত্য বলা হয়। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের শুরুতে মুসলমানদের বিজয়ের ফলে ১২০১ থেকে ১৩৫০ খ্রি. পর্যন্ত প্রচলিত সংস্কৃতিতে যে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে তাতে উল্লেখযোগ্য সাহিত্য রচিত হয় নি বলে এ সময়কালকে বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগ বলে। ১৩৫০ সালের পরবর্তী সময়ে বাংলা কাব্যের দুটি প্রধান ধারা পরিলক্ষিত হয়। একটি হলো কাহিনীকাব্য; অপরটি হলো গীতিকাব্য। প্রথম ধারার কাহিনি কাঠামোর মধ্যে সংগীতধর্মীতা লক্ষণীয়। দ্বিতীয় ধারার প্রধান লক্ষণ সংগীতধর্মিতা ও ভাবধর্মিতা। বড়ু চন্ডীদাস রচিত বাংলা সাহিতের মধ্যযুগের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ কাব্যের নাম “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” । 

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ
 

‘অন্ধকার যুগ’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি বহুল আলোচিত প্রসঙ্গ । খ্রিষ্টীয় ১২০০ সাল থেকে পরবর্তী প্রায় দেড়শ বছর বাংলা সাহিত্যের কোনো উল্লেখযোগ্য নিদর্শন না পাওয়ায় ঐতিহাসিকগণ ঐ সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের ‘অন্ধকার যুগ' হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন । এই হিসেবে ১২০০ সাল থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত মোট দেড়শ বছর হলো অন্ধকার বা তমসার যুগ। তুর্কী আক্রমণকারীদের ভয়ে বৌদ্ধ কবিগণ বঙ্গদেশ থেকে নেপালে শরণার্থী হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। এ কারণে বাংলা সাহিত্যজগতে শূন্যতা দেখা দেয় ।

বখতিয়ার খলজীর বাংলা বিজয়ের ফলে বাংলার প্রচলিত ধর্মীয় সংস্কৃতির বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে । রাজনৈতিক অব্যবস্থা চলতে থাকে । ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধশক্তির নেতৃত্ব চলে যায় মুসলমানদের হাতে। নেতৃত্ব পরিবর্তনে সাময়িকভাবে সৃষ্ট এই বিমূঢ় অবস্থার প্রেক্ষিতে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য সাহিত্যের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এসব কারণে 'চর্যাপদ' বা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' এর মত সাহিত্যগুণসম্পন্ন বাংলা রচনা না পাওয়া গেলেও অনেক ঐতিহাসিক ‘অন্ধকার যুগ' এর ধারণাটিকে স্বীকার করেন না । তাঁরা ১২০১ সাল থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত সময়কে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ হিসেবেই বিবেচনা করে থাকেন ।

এ সময়ের কিছু কিছু রচনা আমরা পেয়ে থাকি। রামাই পণ্ডিত রচিত ‘শূন্যপুরাণ’ এবং ‘কলিমা জালাল' বা 'নিরঞ্জনের রুষ্মা’, ‘ডাক ও খনার বচন'; হলায়ুধ মিশ্রের 'সেক শুভোদয়া’র অন্তর্গত পীর মাহাত্ম্যজ্ঞাপক বাংলা ‘আর্যা’ বা গান প্রভৃতি এ সময়ের বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির নমুনা হিসেবে উল্লেখযোগ্য । খনার বচনে কৃষি ও আবহাওয়া এবং ডাকের বচনে জ্যোতিষ ও মানব চরিত্রের ব্যাখ্যা প্রাধান্য পেয়েছে। 

নিরঞ্জনের উষ্মা

ধর্মপূজা বিধানের প্রথমাংশে পূজার বিষয় এবং বৃহত্তর দ্বিতীয়াংশে ধর্মের অর্চনা, ব্রত-নিয়ম, উপচার প্রভৃতি বর্ণিত। শূন্যপুরাণে ও ধর্মপূজাবিধানে ‘নিরঞ্জনের উষ্মা' বা বড় জালালি কলিমা এবং শেষোক্ত গ্রন্থে ছোট জালালি রয়েছে। ব্রাহ্মণ্যসমাজের ঘৃণা এবং পীড়নপৃষ্ট বিলুপ্তপ্রায় বৌদ্ধ সমাজ প্রতিকার-প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সামর্থ্য হারিয়ে তুর্কিবিজয়কে ধর্মের আশীর্বাদরূপে জেনে হিন্দুর পরাজয়ে ও দুর্দশায় উল্লাসবোধ করে। পরকে ডেকে ঘরের শত্রুকে জব্দ করার নীতি দুর্বল মানুষের নতুন নয় ।

ছোট জালালিতে রয়েছে বিজেতার ধর্মমত বুঝবার চেষ্টা। এই বিজাতি বিধর্মী শাসকদের ও তাদের দেশজ স্বধর্মীর সঙ্গে সহাবস্থানের জন্যে তা প্রয়োজন। সেক শুভোদয়া, ছোট জালালি, পীর পাঁচালি একই উদ্দেশ্যে রচিত। প্রথম দিকে রামাই পণ্ডিতের পীড়ক ছিল হিন্দু। সতের আঠারো শতকে যবন সুলতান এবং উনিশ-বিশ শতকে বাঙালি হিন্দুর পীড়ক হলো ব্রিটিশ, তখন তারা হয় ব্রিটিশ বিদ্বেষী । 

শূন্যপুরাণ

রামাই পণ্ডিত রচিত ধর্মপূজার শাস্ত্রগ্রন্থ শূন্যপুরাণশূন্যপুরাণ ধর্মীয় তত্ত্বের গ্রন্থ - গদ্য পদ্য মিশ্রিত চম্পুকাব্য। এ গ্রন্থে ৫১টি অধ্যায় রয়েছে যার প্রথম ৫টিতে সৃষ্টিতত্ত্বের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এতে বৌদ্ধদের শূন্যবাদ এবং হিন্দুদের লৌকিক ধর্মের মিশ্রণ ঘটেছে। এতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সদ্ধর্মীদের ওপর বৈদিক ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘নিরঞ্জনের রুষ্মা’ কবিতায় ব্রাহ্মণ্য শাসনের বদলে মুসলিম শাসন প্রচলনের পক্ষে মনোভাব ব্যক্ত করা হয়েছে। 

সেক শুভোদয়া

সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি হলায়ুদ মিশ্র রচিত ‘সেক শুভোদয়া’ সংস্কৃত গদ্য-পদ্যে লেখা চম্পুকাব্য। লক্ষণ সেনের অপর বিখ্যাত কবি হলেন জয়দেব। শেখের শুভোদয় অর্থাৎ শেখের গৌরব ব্যাখ্যাই এই পুস্তিকার উপজীব্য। এ গ্রন্থে মুসলমান দরবেশের চরিত্র ও আধ্যাত্মশক্তির পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এটি বাংলা ভাষায় পীর মাহাত্ম্য-জ্ঞাপক কাব্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। 'সেক শুভোদয়া' গ্রন্থের প্রেমসঙ্গীতটিকে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের একমাত্র প্রেমসঙ্গীত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

রামাই পণ্ডিত

ব্রাহ্মণ্য আশ্রিত হওয়ার পর ব্রাহ্মণ্য দেবতার আদলে ও আবরণে ধর্ম ঠাকুরের পূজাপদ্ধতি ও মাহাত্ম্য যিনি নতুন করে প্রচার করেন তিনি রামাই পণ্ডিত। জিন মহাবীর যেমন তাঁর পূর্বেকার তেইশজন তীর্থংকর স্বীকার করেছেন। গৌতম বুদ্ধ যেমন তাঁর পূর্বেকার বোধিসত্ত্বের কথা বলেছেন, তেমনি লোকগ্রাহ্য করবার জন্য রামাই পণ্ডিতও তাঁর আগে তিন যুগে তিন জন ধর্মপূজা-প্রবর্তক যুগাবতার স্বীকার করেছেন । এঁরা হলেন – সত্যযুগের শেতাই, ত্রেতাযুগের নীলাই, দ্বাপরের কংসাই এবং মেহেদীর মতো তাঁর পরেও একজন অবতার আসবেন, তাঁর নাম হবে গোঁসাই।

রামাই পণ্ডিত তের শতকের প্রথম দিকে ধর্মপূজাপদ্ধতি প্রচার করেন। তাঁর 'আদি শূন্যপুরাণ' তেরো শতকের গোড়ার দিকের রচনা। তিনি ডোমবংশীয় পণ্ডিত। তিনি জাজপুর বা উড়িষ্যার অধিবাসী ছিলেন। শূন্যপুরাণের গ্রন্থোক্ত নাম 'আগমপুরাণ'। শূন্যপুরাণ সম্পাদক প্রদত্ত নাম । 

শূন্যপুরাণের সৃষ্টিতত্ত্ব

প্রথমে কিছুই ছিল না, কেবল অনাদি প্রভু ছিলেন ‘শূন্যের ভরমণ প্রভুর শূন্যে করি ভর’। এবং ‘কাহারে জন্মাব পরভু ভাবে মায়াধর'। তারপর ‘অনিল’ দুইজন সৃষ্টি করে ‘বিস্ব’ বা বুদবুদের উপর আসন করলেন, তারপর ‘আপনি সৃজিলেন প্রভু আপনার কায়া'। প্রভুর দেহ থেকে জন্মালেন ‘নিরঞ্জন ধর্ম’। তাঁর ‘হাই” থেকে জন্মালেন উল্লুক পক্ষী। উল্লুকের পৃষ্ঠে বসলেন ধর্ম। উল্লুক ক্লান্ত হলে ধর্ম তাকে মুখামৃত দিলেন, অমৃতের কিছু শূন্যে পড়ল, তা থেকে হলো জল। জলে ভাসল উল্লুক, উল্লুকের পাখা খসে পড়ল জলে, তা থেকে হলো পরমহংস। ধর্ম হাঁসের পিঠে চাপলেন। বহু বহু যুগ পরে ক্লান্ত হাঁস উড়ে পালালো।

জল হলো ঊর্মিমুখর। শান্ত করার জন্য ধর্ম জলে হাত দিলেন, তাতেই কূর্মের উদ্ভব। কূর্মের পিঠে ভর করলেন ধর্ম। উল্লুক ধর্মকে ছায়া দিয়ে পাশে থাকল। একসময়ে ভার অসহ্য হলে কূর্ম পালালো। এবার উল্লুকের পরামর্শে (জলের উপর করু সৃষ্টির সাজন) ধর্ম মন দিলেন কার্যে। প্রথমেই নিজের কণক পৈতা ছিঁড়ে ফেললেন, তাতেই জন্মাল সহস্রফণা বাসুকি। ক্ষুধার্ত বাসুকি আহার খোঁজে, ভীত ধর্ম কানের কুণ্ডল জলে ছুঁড়লেন- তাতে জন্মাল ভেক। তৃপ্ত বাসুকি ধর্মের মাথায় ফণার ছত্র ধরে থাকল। এবার ধর্ম নিজের হাতে তাঁর গলার ময়লাগুলো রাখলেন বাসুকির মাথায়, তাতে তৈরি হলো নবদ্বীপ পৃথিবী।

ধর্ম ও উল্লুক পৃথিবী ঘুরে দেখতে লাগলেন, তাতে ঘর্মাক্ত হলেন পরিশ্রান্ত ধর্ম। তাঁর ঘর্মাক্ত থেকে আদ্যাশক্তিরূপিণী নারীর উদ্ভব হলো। ধর্ম এ সময়ে বল্লুকা নদীও সৃষ্টি করলেন। নদী তীরে ধর্ম প্রজা সৃষ্টির মানসে চৌদ্দযুগ ধরে রইলেন ধ্যানে। এদিকে আদ্যাশক্তি হলেন যৌবনবর্তী। তাঁর যৌবনচেতনা থেকে জন্মাল কাম। উল্লুক কামদেবকে লুকিয়ে রাখল। এতেই বল্লুকায় কালকূট বিষের উদ্ভব। ধ্যানশেষে ধর্ম আদ্যাশক্তির কাছে বিষ ও মধু রেখে বের হলেন তাঁর বরের সন্ধানে। এদিকে যৌবন যন্ত্রণা অসহ্য হওয়ায় আদ্যা বিষ পান করলেন, তাতে মৃত্যুর বদলে তাঁর গর্ভসঞ্চার হলো।

যথাকালে তিনি প্রসব করলেন তিন সন্তান ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিবকে। তিনজনই তখন অন্ধ। জন্মমাত্র তিনজনই তপস্যায় বসলেন বল্লুকাতীরে। ধর্ম তাঁদের পরীক্ষা করবার জন্য গলিত শবরূপে ভেসে চললেন তাঁদের সম্মুখ দিয়ে। ব্রহ্মা-বিষ্ণু তিন অঞ্জলি জল দিয়ে দুর্গন্ধ শবকে দূরে ভাসালেন। শিব কিন্তু বুঝলেন কোথাও যখন মরবার মতো কেউ নেই, তখন এ নিশ্চিত শ্রীধর্মনিরঞ্জনের ছলনা। তাই শিব দুর্গন্ধ শব তুলে নিয়ে নৃত্য করতে লাগলেন । ধর্মের ইচ্ছাক্রমে শিবের মুখামৃতে তিনজনেরই ঘুচল অন্ধত্ব। এ হচ্ছে আসলে জ্ঞানচক্ষুলাভ। তারপর ব্রহ্মাকে সৃষ্টির, বিষ্ণুকে পালনের এবং শিবকে সংহারের ভার দেয়া হলো। আদ্যাশক্তির প্রার্থনাক্রমে শ্রীধর্মনিরঞ্জন তাঁকে বর দিলেন কয়েকবার ইচ্ছামৃত্যু হয়ে তিনি শিবপত্মী হলেন।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য

সর্বজনস্বীকৃত খাঁটি বাংলা ভাষায় রচিত মধ্যযুগের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ হলো 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'। গ্রন্থটির রচয়িতা মধ্যযুগের আদি বা প্রথম কবি বড়ু চণ্ডীদাস। ভাগবতের কৃষ্ণলীলা সম্পর্কিত কাহিনী অনুসরণে, জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ' কাব্যের প্রভাব স্বীকার করে, লোকসমাজে প্রচলিত রাধাকৃষ্ণ প্রেম-সম্পর্কিত গ্রাম্য গল্প অবলম্বনে কবি বড়ু চণ্ডীদাস 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্য রচনা করেন। বড়ু চণ্ডীদাস আনুমানিক চতুর্দশ শতকের কবি। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল অনন্ত। হাতে লেখা পুঁথিখানির প্রথমে দুটি পাতা, মাঝখানে কয়েকটি পাতা ও শেষে অন্তত একটি পাতা নেই। গ্রন্থশেষে কয়েকটি অলিখিত সাদা পাতা আছে। পুঁথিখানিতে গ্রন্থের নাম, রচনাকাল ও পুঁথি-নকলের তারিখ কিছুই নেই।এজন্য কবির পরিচয়,গ্রন্থনাম ও রচনাকাল অংশ পাওয়া যায় নি। তবে পুঁথির সাথে একটি চিরকূট পাওয়া গিয়েছে, তাতে 'শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ' বলে একটা কথা লিখিত আছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামটি প্রদান করেন সম্পাদক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ। 

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কার

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে (১৩১৬ বঙ্গাব্দ) শ্রী বসন্তরঞ্জন রায় পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বনবিষ্ণুপুরের কাঁকিল্যা গ্রামে ভ্রমণকালে দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় নামক এক গৃহস্থের গোয়ালঘরের টিনের চালার নিচ থেকে পুঁথি আকারে অযত্নে রক্ষিত এ কাব্য উদ্ধার করেন। বসন্তরঞ্জন রায় সম্পাদনার পর ১৯১৬ সালে 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' নামে এটি প্রকাশ করে (বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে) তিনি বাংলা সাহিত্যে এক নতুন অধ্যায়ের সংযোজন করেন। বৈষ্ণব মহান্ত শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্র বংশজাত দেবেন্দ্ৰনাথ মুখোপাধ্যায়ের অধিকারে গ্রন্থটি রক্ষিত ছিল । বর্তমানে এটি ২৪৩/১, আচার্য প্রফুল্ল রায় (কলকাতা) রোডের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পুঁথিশালায় সংরক্ষিত আছে। বসন্তরঞ্জন রায়ের উপাধি ছিল 'বিদ্বদ্বল্লভ'। ভুবনমোহনের অধ্যক্ষ তাঁকে এ উপাধি দেন।

রচনাকালের দিক থেকে বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় গ্রন্থ হলো শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য। এর রচনাকাল চতুর্দশ শতক। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি ১৩৪০-১৪৪০ সালের মধ্যে রচিত। এটি নাট-গীত (গীতি-নাট্য) ভঙ্গিতে তের খণ্ডে রচিত। সমস্ত কাব্যে মোট তিনটি চরিত্র আছে -রাধা, কৃষ্ণ ও বড়ায়ি। কাব্যটির বিষয়স্তু হলো রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমলীলা। মর্তবাসী রাধা ও কৃষ্ণের প্রকৃত পরিচয় বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষীদেবী ও বিষ্ণু।

বড়ু চন্ডীদাস লোকসমাজে প্রচলিত রাধা-কৃষ্ণের প্রেম সম্পর্কিত গ্রাম্য গল্প অবলম্বনে ৪১৮ টি পদ,১৬১ টি শ্লোক ও ১৩টি খন্ডের মাধ্যমে পঞ্চদশ শতাব্দীতে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য রচনা করেন। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ মূলত যাত্রাপালা ছিল বলে মনে করা হয়। কারণ কাব্যটি সংস্কৃত গীতগোবিন্দের অনুরুপ গীতি এবং সংলাপবহুল নাট্যলক্ষণাত্নক রচনা বলে অনেক পন্ডিত একে নাট্যগীতিকাব্য হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ড. বিমানবিহারী মজুমদার একে ‘রাধাকৃষ্ণের ধামালী’ বলে অভিহিত করেছেন। ধামালী কথাটির অর্থ- রঙ্গরস,পরিহাস বাক্য, কৌতুক। রঙ্গ তামাসার কালে কপট দম্ভ প্রকাশ করে যে সব উক্তি করা হয়, প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে তাকে ধামালী বলে। নাটপালায় এরুপ ধামালী হাস্যরসের উপাদানরুপে ব্যবহৃত হয়। এ কাব্যে মোট বারটি স্থানে ধামালী কথাটির প্রয়োগ আছে। 

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের সংক্ষিপ্ত কাহিনী

 মধ্যযুগের প্রথম কাব্যগ্রন্থ হলো 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'। গ্রন্থটির রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস। ভাগবতের কৃষ্ণলীলা সম্পর্কিত কাহিনী অনুসরণে, জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ' কাব্যের প্রভাব স্বীকার করে, লোকসমাজে প্রচলিত রাধাকৃষ্ণ প্রেম-সম্পর্কিত গ্রাম্য গল্প অবলম্বনে কবি বড়ু চণ্ডীদাস 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্য রচনা করেন। বড়ু চণ্ডীদাস আনুমানিক চতুর্দশ শতকের কবি। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল অনন্ত। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামটি প্রদান করেন সম্পাদক বসন্তরঞ্জন রায়। হাতে লেখা পুঁথিখানির প্রথমে দুটি পাতা, মাঝখানে কয়েকটি পাতা ও শেষে অন্তত একটি পাতা নেই। গ্রন্থশেষে কয়েকটি অলিখিত সাদা পাতা আছে। পুথিখানিতে গ্রন্থের নাম, রচনাকাল ও পুথি-নকলের তারিখ কিছুই নেই। এ পুথি অন্য কোনো পুথি থেকে অনুলিখিত হয়েছে, না কারো মুখে শুনে লিপিকৃত, তা বুঝবারও কোনো উপায় নেই। এজন্য কবির পরিচয়, গ্রন্থনাম, রচনাকাল অংশ পাওয়া যায়নি। পুঁথির ৪৫২ পৃষ্ঠার মাঝের ৪৫ পৃষ্ঠাও পাওয়া যায়নি। তবে বসন্তরঞ্জন রায় নানা মত পর্যালোচনা, সমীক্ষা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে গ্রন্থটির মূল নাম আবিষ্কারে সচেষ্ট হন এবং এর মূল নাম 'শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ' বলে মতামত প্রদান করেন।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কাহিনী

বড়ায়ি কুট্টিনী চরিত্র। সে চুলপাকা মহিলা। তার আকৃতি যেমন বীভৎস, প্রকৃতিও সেরূপ। বড়ায়িকে আত্মীয়জ্ঞানে রাধার রক্ষণার্থে নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু রক্ষকই ভক্ষক হয়েছে। রাধাকে স্বচক্ষে না দেখে বড়ায়ির মুখে তার রূপযৌবনের কথা শুনেই কৃষ্ণ তাকে পেতে চান। কামপ্রস্তাবে রাধার নিকট অপমানিতা হয়ে বড়ায়ি তার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য কৃষ্ণের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। বৃদ্ধা হলেও তার কামুকতা ঘুচেনি। সে নির্লজ্জভাবে কৃষ্ণকর্তৃক রাধা-সম্ভোগ দেখে আমোদ উপভোগ করেছে এবং তার অবচেতন মনের কাম-পিপাসা চরিতার্থ করেছে। তার মনের এ কাম- প্রবৃত্তির জন্যই যমুনাখণ্ডে নিজে নগ্ন হয়ে, অসহায় গোপবালাদের নগ্ন হতে বলেছে এবং কৃষ্ণকে বস্ত্রহরণে সহায়তা করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত তার মধ্যে মানবীয় গুণের আরোপ করে চণ্ডীদাস তাকে মানবীয়তায় উত্তীর্ণ করেছেন। বাণখণ্ডে বাণাহত রাধার দুর্দশায় তার পাষাণহৃদয় বিগলিত হয়েছে এবং সে কৃষ্ণকে দয়া করতে অনুরোধ করেছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য তের খণ্ডে বিভক্ত । খণ্ডগুলো হলো –

১.জন্ম খণ্ড
২.তাম্বুল খণ্ড
৩.দান খণ্ড
৪. নৌকা খণ্ড
৫. ভার খণ্ড
৬.ছত্র খণ্ড
৭. বৃন্দাবন খণ্ড
৮. কালিয়দমন খণ্ড
৯. যমুনা খণ্ড
১০. হার খণ্ড
১১. বাণ খণ্ড
১২.বংশী খণ্ড
১৩.রাধা-বিরহ খণ্ড 

১.জন্ম খণ্ড

জন্মখণ্ডে মর্ত্যে কৃষ্ণ ও রাধিকার জন্মকাহিনী ব্যক্ত হয়েছে। কৃষ্ণ পাপী কংস রাজাকে বধ করার জন্য দেবকী ও বাসুদেবের সন্তান হিসেবে জন্ম নেয়। তবে পাপী কংস রাজা আগে থেকেই জানত যে দেবকী ও বাসুদেবের সন্তানই তাকে ধ্বংস করবে। এজন্য পাপী কংস রাজা দেবকী ও বাসুদেবকে আলাদা করে তার রাজ দরবারে বন্দী করে রাখে। দেবকী ছিল কংস রাজার বোন। সে হিসেবে কংস কৃষ্ঞের মামা হয়।কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছায় একদিন ঝড়ের রাতে দেবকী ও বাসুদেবের মিলন হয়।তখন দেবকীর গর্ভে সন্তান আসে। দেবকী ও বাসুদেব তাদের সন্তান কৃণ্ঞকে গোপনে তাঁকে অনেক দূরে বৃন্দাবনে জনৈক নন্দ গোপের ঘরে রেখে আসে।সেখানে কৃষ্ঞ বড় হতে থাকে। সেখানেই দৈব ইচ্ছায় আরেক গোপ সাগর গোয়ালার স্ত্রী পদ্মার গর্ভে জন্ম নেয় রাধা। দৈব নির্দেশেই বালিকা বয়সে নপুংসক (ক্লীব) অভিমন্যু বা আইহন বা আয়ান গোপের (ঘোষের) সঙ্গে রাধার বিয়ে হয়। আয়ান গোচারণ করতে গেলে বৃদ্ধা পিসি বড়ায়িকে রাধার তত্ত্বাবধানে রাখা হয়।

২.তাম্বুল খণ্ড

তাম্বুলখণ্ডে বড়ায়ির মারফত রাধার কাছে কৃষ্ণের তাম্বুল প্রণয়োপহার প্রেরণ এবং দানখণ্ডে শুল্ক আদায়ের ছলে কৃষ্ণ কর্তৃক অনিচ্ছুক রাধার উপর বলপ্রয়োগের বৃত্তান্ত বিবৃত হয়েছে। তাম্বুল অর্থ পান। রাধা ঘর থেকে বের হয়ে অন্য গোপীদের সঙ্গে মথুরাতে দই-দুধ বিক্রি করতে যায়। বড়ায়ি তাঁর সঙ্গে যায়। বৃদ্ধা বড়ায়ি পথে রাধাকে হারিয়ে ফেলে এবং রাধার রূপের বর্ণনা দিয়ে কৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করে, এমন রূপসীকে সে দেখেছে কিনা। এই রূপের বর্ণনা শুনে রাধার প্রতি কৃষ্ণ পূর্বরাগ অনুভব করে। সে বড়ায়িকে বুঝিয়ে রাধার জন্য পান ও ফুলের উপহারসহ প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু বিবাহিতা রাধা সে প্রস্তাব পদদলিত করে।

৩.দান খণ্ড

দই-দুধ বিক্রির জন্য মথুরাগামী রাধা ও গোপীদের পথ রোধ করে কৃষ্ণ। তার দাবী নদীর ঘাটে পারাপার-দান বা শুল্ক দিতে হবে, তা না হলে রাধার সঙ্গে মিলিত হতে দিতে হবে। রাধা কোনোভাবেই এ প্রস্তাবে রাজী হয় না। এ দিকে তাঁর হাতেও কড়ি নেই। সে নিজের রূপ কমাবার জন্য চুল কেটে ফেলতে চাইল; কৃষ্ণের হাত থেকে বাঁচবার জন্য বনে দৌড় দিল। কৃষ্ণও পিছু ছাড়বার পাত্র নয়। অবশেষে কৃষ্ণের ইচ্ছায় কর্ম হয়।

৪. নৌকা খণ্ড

নৌকাখণ্ডে কৃষ্ণ কর্তৃক যমুনা নদীতে নৌকা ডুবিয়ে যমুনায় রাধার সঙ্গে মিলনের এবং ভারখণ্ডে ও ছত্রখণ্ডে ইন্দ্রিয়বিলাসের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণের বাহকবৃত্তির কথা বলা হয়েছে। দানখন্ডের পর থেকে রাধা কৃষ্ণকে এড়িয়ে চলে। কৃষ্ণ নদীর মাঝির ছদ্মবেশ ধারণ করে। একজন পার করা যায় এমন একটি নৌকাতে রাধাকে তুলে সে মাঝ নদীতে নিয়ে নৌকা ডুবিয়ে দেয় এবং রাধার সঙ্গ লাভ করে। নদী তীরে উঠে লোকলজ্জার ভয়ে রাধা সখীদের বলে যে, নৌকা ডুবে গিয়েছে, কৃষ্ণ না থাকলে সে নিজেও মরত, কৃষ্ণ তাঁর জীবন বাঁচিয়েছে।

৫. ভার খণ্ড

শরৎকাল। শুকনো পথ ঘাটে হেঁটেই মথুরাতে গিয়ে দই-দুধ বিক্রি করা যায়। কিন্তু রাধা আর বাড়ির বাইরে আসে না। শাশুড়ি বা স্বামীকে সে আগের ঘটনাগুলো ভয়ে ও লজ্জায় খুলে বলে নি। এদিকে রাধা অদর্শনে কৃষ্ণ কাতর। সে বড়ায়িকে দিয়ে রাধার শাশুড়িকে বোঝায়, ঘরে বসে থেকে কি হবে, রাধা দুধ-দই বেচে কটি পয়সা তো আনতে পারে। শাশুড়ির নির্দেশে রাধা বাইরে বের হয়। জিন্তু প্রচণ্ড রোদে কোমল শরীরে দই-দুধ বহন করতে গিয়ে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এই সময়ে কৃষ্ণ ছদ্মবেশে মজুরী করতে আসে। পরে ভার বহন অর্থাৎ মজুরির বদলে রাধার আলিঙ্গন কামনা করে। রাধা এই চতুরতা বুঝতে পারে। সেও কাজ আদায়ের লক্ষ্যে মিথ্যা আশ্বাস দেয়। কৃষ্ণ আশায় আশায় রাধার পিছু পিছু ভার নিয়ে মথুরা পর্যন্ত চলে।

৬.ছত্র খণ্ড

ছত্রখণ্ডে পসরা বিক্রি করে চন্দ্রাবলী মথুরা থেকে ফিরছেন । শরতের রোদের তাপ থেকে তাঁকে রক্ষা করার জন্য কৃষ্ণ তাঁর মাথার উপর ছত্র ধারণ করেছেন । দুধ-দই বেচে এবার মথুরা থেকে ফেরার পালা। কৃষ্ণ তাঁর প্রাপ্য আলিঙ্গন চাইছে। রাধা চালাকি করে বলে, ‘এখনো প্রচণ্ড রোদ। তুমি আমাদের ছাতা ধরে বৃন্দাবন পর্যন্ত চলো। পরে দেখা যাবে’। কৃষ্ণ ছাতা ধরতে লজ্জা ও অপমান বোধ করছিল। তবুও আশা নিয়ে ছাতা ধরেই চলল। কিন্তু তাঁর আশা পূর্ন করেনি রাধা।

৭. বৃন্দাবন খণ্ড

বৃন্দাবনখণ্ডে বড়ায়ির অনুরোধে কৃষ্ণ কর্তৃক ফুলে ফলে সজ্জিত রাধার বৃন্দাবনে গমন এবং সেখানে রাধাকৃষ্ণের মিলনের কথা বলা হয়েছে । রাধার বিরুদ্ধ মনোভাব কৃষ্ণকে ভাবান্তর ঘটায়। সে অন্য পথ অবলম্বন করে। নিজে কটু বাক্য বলে না, দান বা শুল্ক আদায়ের নামে বিড়ম্বনা করে না, বরং বৃন্দাবনকে অপূর্ব শোভায় সাজিয়ে তুলল। রাধা ও গোপীরা সেই শোভা দর্শন করে কৃষ্ণের উপর রাগ ভুলে যায়। তাঁরা পরিবর্তিত কৃষ্ণকে দেখতে আগ্রহ দেখায়। কৃষ্ণ সব গোপিকে দেখা দেয়। পরে রাধার সঙ্গে তাঁর দর্শন ও মিলন হয়।

৮. কালিয়দমন খণ্ড

কালিয়দমনখণ্ডে যমুনার কালিয় দহের কালিয় নাগকে সপরিবারে দক্ষিণ সাগরে পাঠিয়ে কৃষ্ণ কালিয়দহের বিপদ দূর করেন । যমুনা নদী বৃন্দাবনের উপর দিয়ে প্রবাহিত। সেখানে কালিয়নাগ বাস করে। তার বিষে সেই জল বিষাক্ত। কৃষ্ণ কালিয়নাগকে তাড়াতে নদীর জলে ঝাঁপ দেন। দৈব ইচ্ছায় ও কৃষ্ণের বীরত্বে কালিয়নাগ পরাস্ত হয় এবং দক্ষিন সাগরে বসবাস করতে যায়। কালিয়নাগের সঙ্গে কৃষ্ণ যখন জলযুদ্ধে লিপ্ত, তখন রাধার বিশেষ কাতরতা প্রকাশ পায়।

৯. যমুনা খণ্ড

যমুনাখণ্ডে রাধা-কৃষ্ণের যমুনাবিহার, কৃষ্ণ কর্তৃক গোপিনিদের বস্ত্র অপহরণের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। রাধা ও গোপীরা যমুনাতে জল আনতে যায়। কৃষ্ণ যমুনার জলে নেমে হটাৎ ডুব দিয়ে আর উঠে না। সবাই মনে করে কৃষ্ণ দুবে গেছে। এদিকে কৃষ্ণ লুকিয়ে কদম গাছে বসে থাকে। রাধা ও সখীরা জলে নেমে কৃষ্ণকে খুঁজতে থাকে। কৃষ্ণ নদী তীরে রাধার খুলে রাখা হার চুরি করে আবার গাছে গিয়ে বসে।

১০. হার খণ্ড

হারখণ্ডে কৃষ্ণ কর্তৃক রাধার হার-অপহরণ ও যশোদার কাছে রাধার অভিযোগ পেশের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। পরে কৃষ্ণের চালাকি রাধা বুঝতে পারে। হার না পেয়ে রাধা কৃষ্ণের পালিতা মা যশোদার কাছে নালিশ করে। কৃষ্ণও মিথ্যে বলে মাকে। সে বলে, আমি হার চুরি করব কেন, রাধাতো পাড়া সম্পর্কে আমার মামি। এদিকে বড়ায়ি সব বুঝতে পারে এবং রাধার স্বামী আয়ান হার হারানোতে যাতে রাগান্বিত বা ক্ষুব্ধ না হয় সেজন্য বলে যে, বনের কাঁটায় রাধার গজমোতির হার ছিন্ন হয়ে হারিয়ে গেছে।

১১. বাণ খণ্ড

বাণখণ্ডে রাধার প্রতি কৃষ্ণের সম্মোহনবাণ নিক্ষেপের কাহিনী বিবৃত হয়েছে । মায়ের কাছে নালিশ করায় কৃষ্ণ রাধার উপর ক্ষুব্ধ। রাধাও কৃষ্ণের প্রতি প্রসন্ন নয়। বড়ায়ি বুদ্ধি দিল, কৃষ্ণ যেন শক্তির পথ পরিহার করে মদনবাণ বা প্রেমে রাধাকে বশীভূত করে। সে মতো কৃষ্ণ পুষ্পধনু নিয়ে কদমতলায় বসে। রাধা কৃষ্ণের প্রেমবাণে মূর্চ্ছিত ও পতিত হয়। এরপর কৃষ্ণ রাধাকে চৈতন্য ফিরিয়ে দেয়। রাধা কৃষ্ণপ্রেমে কাতর হয়ে কৃষ্ণকে খুঁজে ফেরে।

১২.বংশী খণ্ড

বংশীখণ্ডে রাধা কর্তৃক কৃষ্ণের বংশী অপহরণ এবং রাধা-বিরহখণ্ডে রাধার নিদ্রার অবকাশে কৃষ্ণের মথুরায় পলায়নের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে । রাধাকে আকৃষ্ট করার জন্য সময়-অসময়ে কৃষ্ণ বাঁশিতে সুর তোলে। কৃষ্ণের বাঁশি শুনে রাধার রান্না এলোমেলো হয়ে যায়, মন কুমারের চুল্লির মতো পুড়তে থাকে, রাত্রে ঘুম আসে না, ভোর বেলা কৃষ্ণ অদর্শনে রাধা মূর্চ্ছা যায়। বড়ায়ি রাধাকে পরামর্শ দেয়, সারারাত বাঁশি বাজিয়ে সকালে কদমতলায় কৃষ্ণ বাঁশি শীয়রে রেখে ঘুমায়। তুমি সেই বাসি চুরি কর, তাহলেই সমস্যার সমাধান হবে। রাধা তাই করে। কৃষ্ণ বুদ্ধিমান। বাঁশি চোর কে তা বুঝতে তাঁর কোনো কষ্ট হয় না। রাধা কৃষ্ণকে বলে, বড়ায়িকে সাক্ষী রেখে কৃষ্ণকে কথা দিতে হবে যে, সে কখনো রাধার কথার অবাধ্য হবে না ও রাধাকে ত্যাগ করে যাবে না, তাহলেই বাঁশির সন্ধান মিলতে পারে। কৃষ্ণ কথা দিয়ে বাঁশি ফিরে পায়।

১৩.রাধা-বিরহ খণ্ড

কৃষ্ণ তারপরও রাধার উপর উদাসীন। এদিকে মধুমাস সমাগত।রাধা বিরহ অনুভব করে। রাধা বড়ায়িকে কৃষ্ণকে এনে দিতে বলে। দই-দুধ বিক্রির ছল করে রাধা নিজেও কৃষ্ণকে খুঁজতে বের হয়। অবশেষে বৃন্দাবনে বাঁশি বাজানো অবস্থায় কৃষ্ণকে খুঁজে পাওয়া যায়। কৃষ্ণ রাধাকে বলে, ‘তুমি আমাকে নানা সময় লাঞ্ছনা করেছো, ভার বহন করিয়েছো, তাই তোমার উপর আমার মন উঠে গেছে’। রাধা বলে, ‘তখন আমি বালিকা ছিলাম, আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমার বিরহে মৃতপ্রায়। তির্যক দৃষ্টি দিলেও তুমি আমার দিকে তাকাও’। কৃষ্ণ বলে, ‘বড়ায়ি যদি আমাকে বলে যে তুমি রাধাকে প্রেম দাও, তাহলে আমি তোমার অনুরোধ রাখতে পারি’। অবশেষে বড়ায়ি রাধাকে সাজিয়ে দেয় এবং রাধা কৃষ্ণের মিলন হয়। রাধা ঘুমিয়ে পড়লে কৃষ্ণ নিদ্রিত রাধাকে রেখে কংসকে বধ করার জন্য মথুরাতে চলে যায়। ঘুম থেকে উঠে কৃষ্ণকে না দেখে রাধা আবার বিরহকাতর হয়। রাধার অনুরোধে বড়ায়ি কৃষ্ণের সন্ধানে যায় এবং মথুরাতে কৃষ্ণকে পেয়ে অনুরোধ করে, ‘রাধা তোমার বিরহে মৃতপ্রায়। তুমি উন্মাদিনীকে বাঁচাও’। কিন্তু কৃষ্ণ বৃন্দাবনে যেতে চায় না, রাধাকে গ্রহন করতে চায় না। কৃষ্ণ বলে, ‘আমি সব ত্যাগ করতে পারি, কিন্তু কটু কথা সহ্য করতে পারি না। রাধা আমাকে কটু কথা বলেছে’। (‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য এখানে ছিন্ন। পৃষ্ঠা পাওয়া না যাওয়ায়, এ কাব্যের সমাপ্তি কেমন তা জানা যায় নি।)

কাহিনি বর্ণনায় এক খণ্ডের কাহিনীর সঙ্গে পরবর্তী খণ্ডের কাহিনীর সম্পর্কসূত্র সুন্দরভাবে গ্রথিত হয়েছে। এ কাহিনী জনগণের মনোরঞ্জনের জন্য রচিত এবং প্রায় সবখানিই কবির স্বকপোলকল্পিত । পুরাণের কাহিনীর সঙ্গে এর সম্পর্ক অত্যন্ত ক্ষীণ।কবি এ কাব্যের সর্বত্র ভাগবতের হুবহু অনুসরণ করেন নি। কোনো কোনো খণ্ড ভাগবতের অনুসরণে নির্মিত, আবার কোনো কোনো খণ্ডে কবি কল্পনার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। এ বিরাট গ্রন্থের মুখ্য পাত্রপাত্রী মাত্র তিনজন-কৃষ্ণ, রাধা ও বড়ায়ি । এ তিনজনের সংলাপের মধ্য দিয়েই সমস্ত কাহিনী নাটকীয়গুণে মণ্ডিত হয়ে উঠেছে। প্রতিটি ঘটনা নাটকীয় ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথম দিকে কৃষ্ণের প্রতি যে-রাধিকার বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখা যায় না, বংশীখণ্ড থেকে তিনিই কৃষ্ণপ্রেমে পাগলিনী। আর একদিকে বংশীখণ্ডের পূর্ব পর্যন্ত যে কৃষ্ণ রাধাবিরহে পাগলপ্রায়, সে কৃষ্ণই আবার বংশী ও বিরহখণ্ডে চরম ঔদাসীন্য ও নির্লিপ্ততার পরিচয় দিয়েছেন। জন্মখণ্ডের মধ্যে আমরা একবার নারদকে পাই; এরপর আবার বিরহখণ্ডে পরম এক নাটকীয় মুহূর্তে তাঁর দর্শন মেলে। পরে কৃষ্ণবিরহে কাতর শ্রীরাধিকার এক ব্যথাবিধুর মুহূর্তে পরম উপকারীর বেশে নারদের উপস্থিতি যেন সকল পাঠকের একান্ত কাম্য মনে হয়। আবার রাধাকৃষ্ণের মিলনের লগ্নকে উপভোগ্য করার জন্য যখন একটা উত্তেজনার আবহ পাঠকমনে রসচেতনার জোয়ার বয়ে আনে, ঠিক সেই মুহূর্তে কৃষ্ণদর্শনে মুগ্ধ রাধাকে কবি সংজ্ঞাহীন মূর্ছিতা করে চরম নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছেন । এভাবে দানখণ্ডে রাধা- কৃষ্ণের উক্তি-প্রত্যুক্তিতে, নৌকাখণ্ডে হঠাৎ নৌকা-নিমজ্জনে, বংশীখণ্ডে নিদ্রিত কৃষ্ণের নিকট থেকে বংশী চুরি এবং পরে কৃষ্ণের যোগীবেশ ধারণ প্রভৃতি ঘটনায় গ্রন্থের প্রায় সর্বত্রই নাটকীয় সংঘটনের আভাস পাওয়া যায় ।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা সাগর গোয়ালার কন্যা। তাঁর আর এক নাম চন্দ্রাবলী। তাঁর মায়ের নাম পদুমিনী। সেখানে রাধার সখিদের বা কৃষ্ণের সখাদের নামোল্লেখ নেই । পদাবলির রাধা বৃকভানু বা বৃষভানু রাজার কন্যা । কলাবতী বা কীর্তিদা তাঁর জননী। চন্দ্রাবলী তাঁর সখি ও প্রতিনায়িকা। এখানে রাধার সখিদের ও কৃষ্ণের সখাদের নামোল্লেখ পাওয়া যায়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কৃষ্ণের আবির্ভাবের একমাত্র কারণ কংসবধ। কাব্যের শেষ দিকে শ্রীকৃষ্ণ কংসবধের উদ্দেশ্যেই রাধাকে ছেড়ে মথুরায় চলে যান । কিন্তু পদাবলিতে বৃন্দাবন-রস আস্বাদনের জন্যই কৃষ্ণের মর্তে আগমন ।

চন্ডীদাস সমস্যা

চণ্ডীদাসের পদাবলি দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত থাকায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্য আবিষ্কারের পর বাংলা সাহিত্যে চণ্ডীদাস সমস্যার উদ্ভব ঘটে। ১৯৪১ সালে মণীন্দ্রনাথ বসু কর্তৃক দীন চণ্ডীদাসের পদাবলি আবিষ্কৃত হলে চণ্ডীদাস সমস্যা আরো প্রকট হয়। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন পদাবলির দ্বিজ চণ্ডীদাস এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বড়ু চণ্ডীদাসকে একই ব্যক্তি বলে মত দিয়েছেন । পরবর্তীতে দীন চণ্ডীদাসের পদাবলি আবিষ্কারের পর তিনজন চণ্ডীদাসের অস্তিত্ব সম্পর্কে পণ্ডিতদের অনেকেই একমত হন। এ তিনজন হলেন - বড়ু চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস ও দীন চণ্ডীদাস। চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগে ছিলেন বড়ু চণ্ডীদাস ও দ্বিজ চণ্ডীদাস এবং চৈতন্য পরবর্তী যুগে ছিলেন দীন চণ্ডীদাস ।

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url