জসীম উদ্দীনের কবর কবিতার মূলভাব
জসীম উদ্দীন ১৯০৪ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে মাতুলানায় জন্মগ্রহণ করেন। মোহাম্মাদ জমীর উদ্দীন মোল্লা তার পূর্ণ নাম হলেও তিনি জসীম উদ্দিীন নামেই পরিচিত। তার বাবার বাড়ি ছিল একই জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে। বাবার নাম আনসার উদ্দিন মোল্লা। তিনি পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। মা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট।
জসীম উদ্ দীন একদম অল্প বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। কলেজে অধ্যয়নরত
থাকা অবস্থায়, পরিবার এবং বিয়োগান্ত দৃশ্যে, একদম সাবলীল ভাষায় তিনি বিশেষ আলোচিত
কবিতা কবর লেখেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায়
এই কবিতাটি প্রবেশিকার বাংলা পাঠ্যবইয়ে স্থান পায়।
তিনি ১৪ মার্চ ১৯৭৬ সনে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার শেষ
ইচ্ছা অনুসারে তাকে ফরিদপুর জেলার অম্বিকাপুর গ্রামে তার দাদীর কবরের পাশে দাফন করা
হয়।
রবীন্দ্র প্রভাব বলয়মুক্ত বাংলা কবিতা লেখার অভিপ্রায়ে কল্লোল
গোষ্ঠীর আবির্ভাব। এই কল্লোল পত্রিকাকে ঘিরে তিরিশের দশকে কবিতার আধুনিকতা নির্মাণ
করলেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণু দে।
এর সমসাময়িকে আরো অনেকেই ছিলেন তাদের অন্যতম হচ্ছেন সমর সেন। ঠিক ওই সময়ে কল্লোল গোষ্ঠীর
তালিকায় অবিভক্ত ভারতবর্ষের পূর্ববাংলা থেকে আরো এক কবি যুক্ত হলেন, তিনি জসীম উদ্্দীন।
কিন্তু কল্লোল পত্রিকার প্রথম দুই সংখ্যায় তার কবিতা ছাপা হলেও তা তেমন সাড়া জাগাতে
পারেনি। তবে কল্লোলের তৃতীয় সংখ্যায় ‘কবর’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠক মহল থেকে
শুরু করে সাহিত্যের বিদগ্ধজনরাও নড়েচড়ে বসলেন।
‘কবর’ কবিতার এক সম্মোহনী শক্তি ছিল যে কারণে কবির ছাত্রাবস্থায়
কবিতাটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য বাংলা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত
হয়! এটি ১১৮ চরণের এক দীর্ঘ আখ্যান কবিতা। শোকবিহ্বলচিত্তে পিতামহ তার একমাত্র দৌহিত্রকে
দাদি, বাবা-মা, ফুফু ও বড় বোনের কবর দেখিয়ে অতীত স্মৃতি বর্ণনা করে চলেছেন। মানুষ মাত্রই
এ কবিতায় আবেগ আপ্লুত হবে, সন্দেহ নেই। বারংবার মৃত্যুকথা এর শোকাবহ আবহটিকে একঘেয়ে
করে তোলেনি শুধু কবির অসাধারণ উপস্থাপনার কারণে। মৃত্যুর মুহুর্মুহু উপস্থাপনা সত্ত্বেও
এখানে সংযম ছিল, সরলতার পাশাপাশি ছিল আবেগী তীব্রতা। আর কবিতার ভাষায় ছিল প্রমিত বাংলার
সঙ্গে কিছু আঞ্চলিক শব্দের সার্থক প্রয়োগ। এর ছন্দ ও অলঙ্কারও শাদামাটা, কেবল আন্তরিকতা
ও বিশ্বাসযোগ্যতা ‘কবর’ কবিতাকে পাঠকের মর্মমূলে গেথে দিয়েছে।
‘কবর’ কবিতায় বৃদ্ধ পিতামহ একমাত্র জীবিত দৌহিত্রকে তার প্রেমময়ী
স্ত্রী, উপযুক্ত পুত্র, লক্ষ্মী পুত্রবধূ, আদরের নাতনি এবং স্নেহের পুত্তলী মেয়ের বিয়োগান্তক
বিদায়ের কথা জানাতে গিয়ে এক দুর্বিষহ মরুময় জীবনের দুঃস্বপ্নকে বর্ণনা করেছেন। এক দুঃসহ
বেদনায় তার অস্তিত্বকে বহন করে বেঁচে থাকার অপরাধ বোধের গ্লানি তিনি ব্যক্ত করতে চান।
আর তাই দিন-রাত মৃত্যু কামনা তার সব ভাবনাকে তাড়িত করে।
‘কবর’ কবিতায় যে বেদনাবিধুর আর্তি ধ্বনিত হয়েছে, তা কেবল গ্রামীণ
জনপদের নয়; বরং এ সব সময়ের আধুনিক-অনাধুনিক, উঁচু-নিচু, বালক-বৃদ্ধ সবার। কবিতাটির
আবেদনও তাই কাল-পাত্র-পরিবেশ ছাপিয়ে বিশ্ব-চরাচরে গৃহীত হয়েছে মানব-অন্তরের গভীর অনুভূতির
আয়নায়।
জসীম উদ্দীনের ‘কবর’ কবিতা বাংলা সাহিত্যের একটি অনন্যসাধারণ রচনা। কবিতাটি একটি সংলাপধর্মী শোকগাথা, যেখানে কবি অতীত স্মৃতির আলোকে পিতামহ, পিতামাতা এবং পারিবারিক জীবনের অন্তর্নিহিত মায়া-মমতা তুলে ধরেছেন। কবিতাটি মানবজীবনের সাময়িকতা, পারিবারিক সম্পর্কের গভীরতা, এবং মৃত্যুর অনিবার্যতা নিয়ে এক মর্মস্পর্শী উপলব্ধি তৈরি করে। এটি বাঙালি গ্রামীণ জীবনের আবেগঘন চিত্রকল্প এবং গভীর জীবনবোধের প্রকাশ।
‘কবর’ কবিতায় পিতামহের কণ্ঠে অতীত জীবনের স্মৃতিচারণা ফুটে উঠেছে, যা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে গভীর ভালোবাসা এবং মায়াময় সম্পর্কের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কবিতার চরিত্ররা মৃত্যুবরণ করলেও তাদের স্মৃতি বেঁচে থাকে জীবিতদের মনে। কবি বোঝাতে চান, পারিবারিক সম্পর্কের আবেগ, ত্যাগ এবং ভালোবাসা মৃত্যুর পরও অমর থাকে।
জীবন এবং মৃত্যুর মধ্যকার অনিবার্যতা কবিতার একটি মূল দিক। পিতামহ তাঁর জীবনের শেষ সময়ে এসে কবরে শায়িত পিতামাতা এবং স্ত্রীর কথা স্মরণ করে মৃত্যুকে এক প্রাকৃতিক এবং অবশ্যম্ভাবী বিষয় হিসেবে মেনে নিচ্ছেন। কবিতাটি এই সত্য তুলে ধরে যে, জীবন ক্ষণস্থায়ী, এবং মৃত্যুই জীবনের শেষ গন্তব্য। তবে এই মৃত্যুর মধ্যেও এক ধরনের শান্তি এবং স্বস্তি লুকিয়ে আছে, কারণ প্রিয়জনদের সান্নিধ্য মৃত্যুর পরও কবরের নীরবতায় অনুভব করা যায়।
জসীম উদ্দীন তাঁর কবিতায় গ্রামীণ সমাজের সহজ-সরল জীবনধারা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। পিতামহের বর্ণনায় গ্রামের মানুষের পারিবারিক বন্ধন, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এবং একে অপরের প্রতি দায়িত্ববোধ স্পষ্ট হয়। শহুরে জীবনের কোলাহল থেকে দূরে, এই গ্রামীণ জীবন যেন মানবজীবনের প্রকৃত সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি।
কবিতায় মৃত্যুর কোনো ভয় বা হতাশার ছায়া নেই; বরং এতে একধরনের শান্তির বার্তা প্রতিফলিত হয়েছে। পিতামহের বিশ্বাস যে মৃত্যুর পর প্রিয়জনদের পাশে শায়িত হওয়া যায়, এটি একটি মানসিক প্রশান্তির উৎস। কবি এইভাবে জীবনের শেষ পর্যায়কে মেনে নেওয়ার মানসিকতা এবং মৃত্যুকে ভয় না করার শিক্ষাও দিয়েছেন।
‘কবর’ কবিতাটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং মানুষ যতই চেষ্টা করুক, মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই। তবে জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় প্রিয়জনদের ভালোবাসা এবং আত্মত্যাগের মধ্যে। কবিতাটি একধরনের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি দেয়, যেখানে মৃত্যু জীবনের একটি স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে মেনে নেওয়া হয়।
জসীম উদ্দীনের ‘কবর’ কবিতা জীবনের সাময়িকতা এবং সম্পর্কের মায়াময়তাকে অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে উপস্থাপন করে। এটি গ্রামীণ জীবনের নিস্তরঙ্গ মাধুর্য এবং পারিবারিক বন্ধনের শক্তিকে তুলে ধরে। কবি বোঝাতে চান যে, মৃত্যুর পরও প্রিয়জনদের স্মৃতিতে মানুষ বেঁচে থাকে এবং এই স্মৃতিই জীবনের সত্যিকারের সম্পদ। কবিতাটি বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানবীয় আবেগের এক চিরন্তন প্রতিফলন, যা আজও পাঠকদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।
পাঠকের সুবিধার্তে কবর কবিতাটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
কবর
জসীম উদদীন
এইখানে
তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ
বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু
তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মত মুখ,
পুতুলের
বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে
ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা
সারা
বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা।
সোনালি
ঊষার সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি
লাঙল
লইয়া ক্ষেতে ছুটিতাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।
যাইবার
কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত
এ-কথা
লইয়া ভাবী-সাব মোরে তামাশা করিত শত।
এমনি
করিয়া জানি না কখন জীবনের সাথে মিশে
ছোট-খাটো
তার হাসি-ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে।
বাপের
বাড়িতে যাইবার কালে কহিত ধরিয়া পা
''আমারে
দেখিতে যাইও কিন্তু, উজান-তলীর গাঁ।''
শাপলার
হাটে তরমুজ বেচি দু-পয়সা করি দেড়ী,
পুঁতির
মালার একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি।
দেড়
পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,
সন্ধ্যাবেলায়
ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে!
হেসো
না-হেসো না- শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে
দাদী
যে তোমার কত খুশি হত দেখতিস যদি চেয়ে!
নথ
নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, ''এতদিন পরে এলে,
পথ
পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেদে মরি আঁখিজলে''।
আমারে
ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়,
কবর
দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝঝুম নিরালায়!
হাতজোড়
করে দোয়া মাঙ- দাদু, 'আয় খোদা দয়াময়,
আমার
দাদীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নসিব হয়।'
তারপর
এই শূন্য জীবনে কত কাটিয়াছি পাড়ি
যেখানে
যাহার জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।
শত
কাফনের শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি,
গণিয়
গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।
এই
মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে,
গাড়িয়া
দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।
মাটিরে
আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে মিশায়ে বুক,
আয়-
আয় দাদু, গলাগলি ধরি- কেঁদে যদি হয় সুখ।
এইখানে
তোর বাপজি ঘুমায়, এইখানে তোর মা,
কাঁদছিস
তুই? কী করিব দাদু! পরাণ যে মানে না।
সেই
ফাল্গুনে বাপ তোর আসি কহিল আমারে ডাকি,
'বা-জান,
আমার শরীর আজিকে কী যে করে থাকি থাকি।'
ঘরের
মেঝেতে সপটি বিছায়ে কহিলাম, '' বাছা শোও''
সেই
শোয়া তার শেষ শোয়া হবে তাহা কি জানিত কেউ?
গোরের
কাফনে সাজায়ে তাহারে চলিলাম যবে বয়ে,
তুমি
যে কহিলা, 'বা-জানরে মোর কোথা যাও দাদু লয়ে?'
তোমার
কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে,
সারা
দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে!
তোমার
বাপের লাঙল-জোয়াল দু-হাতে জড়ায়ে ধরি,
তোমার
মায়ে যে কতই কাঁদিত সারা দিনমান ভরি।
গাছের
পাতারা সেই বেদনায় বুনো পথে যেত ঝরে,
ফাল্গুনী
হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শূন্য-মাঠখানি ভরে।
পথ
দিয়া যেতে গেঁয়ে পথিকেরা মুছিয়া যাইত চোখ,
চরণে
তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক।
আথালে
দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি,
হাম্বা
রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি।
গলাটি
তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা,
চোখের
জলের গহিন সায়রে ডুবায়ে সকল গা।
উদাসিনী
সেই পল্লী-বালার নয়নের জল বুঝি,
কবর
দেশের আন্ধার ঘরে পথ পেয়েছিল খুঁজি।
তাই
জীবনের প্রথম বেলায় ডাকিয়া আনিল সাঁঝ,
হায়
অভাগিনী আপনি পরিল মরণ-বিষের তাজ।
মরিবার
কালে তোরে কাছে ডেকে কহিল, 'বাছারে যাই,
'বড়
ব্যথা র'ল, দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই;
দুলাল
আমার, জাদুরে আমার, লক্ষী আমার ওরে,
কত
ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে।'
ফোঁটায়
ফোঁটায় দুইটি গণ্ড ভিজায়ে নয়ন-জলে,
কী
জানি আশিস করে গেল তোরে মরণ-ব্যথার ছলে।
ক্ষণপরে
মোরে ডাকিয়া কহিল, 'আমার কবর গায়
স্বামীর
মাথার মাথালখানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়।'
সেই
সে মাথাল পচিয়া গলিয়া মিশেছে মাটির সনে,
পরাণের
ব্যথা মরে নাকো সে যে কেঁদে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে।
জোড়মানিকেরা
ঘুমায়ে রয়েছে এই খানে তরু-ছায়,
গাছের
শাখারা স্নেহের মায়ায় লুটায়ে পড়েছে পায়।
জোনাকি
মেয়েরা সারারাত জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো,
ঝিঁঝিঁরা
বাজায় ঘুমের নূপুর কত যেন বেসে ভালো।
হাতজোড়
করে দোয়া মাঙ দাদু, 'রহমান খোদা! আয়;
ভেস্ত
নসিব করিও আজিকে আমার বাপ ও মায়!'
এই
খানে তোর বু-জির কবর, পরীর মতন মেয়ে,
বিয়ে
দিয়েছিনু কাজিদের বাড়ি বুনিয়াদি ঘর পেয়ে।
এত
আদরেরর বু-জিরে তাহারা ভালোবাসিত না মোটে,
হাতেতে
যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে।
খবরের
পর খবর পাঠাত, 'দাদু যেন কাল এসে
দু-দিনের
তরে নিয়ে যায় মোরে বাপের বাড়ির দেশে।'
শ্বশুর
তাহার কসাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে,
অনেক
কহিয়া সেবার তাহারে আনিলাম এক শীতে।
সেই
সোনামুখ মলিন হয়েছে ফোটে না সেথায় হাসি,
কালো
দুটি চোখে রহিয়া রহিয়া অশ্রু উঠিছে ভাসি।
বাপের
মায়ের কবরে বসিয়া কাঁদিয়া কাটাত দিন,
কে
জানিত হায়, তাহারও পরাণে বাজিবে মরণ-বীণ!
কী
জানি পচানো জ্বরেতে ধরিল আর উঠিল না ফিরে,
এইখানে
তারে কবর দিয়েছি দেখে যাও দাদু! ধীরে!
ব্যথাতুরা
সেই হতভাগিনীরে কেউ বাসে নাই ভালো,
কবরে
তাহার জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাসগুলি কালো।
বনের
ঘুঘুরা উহু-উহু করি কেঁদে মরে রাতদিন,
পাতায়
পাতায় কেঁপে উঠে যেন তারি বেদনার বীণ।
হাতজোড়া
করি দোয়া মাঙ দাদু, 'আয় খোদা! দয়াময়!
আমার
বু-জির তরেতে যেন গো ভেস্ত নাজেল হয়!'
হেথায়
ঘুমায়ে তোর ছোট ফুপু, সাত বছরেরর মেয়ে,
রামধনু
বুঝি নেমে এসেছিল ভেস্তের দ্বার বেয়ে।
ছোট
বয়সেই মায়েরে হারায়ে কী জানি ভাবিত সদা,
অতটুকু
বুকে লুকাইয়াছিল কে জানিত কত ব্যথা!
ফুলের
মতোন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে,
তোমার
দাদীর ছবিখানি মোর হৃদয়ে উঠিত ছেয়ে।
বুকেতে
তাহারে জড়ায়ে ধরিয়া কেঁদে হইতাম সারা,
রঙিন
সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে দিত মোদের চোখের ধারা।
একদিন
গেনু গজনার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে,
ফিরে
এসে দেখি সোনার প্রতিমা লুটায়ে পথের 'পরে।
সেই
সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে,
কী
জানি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গেছে।
আপন
হস্তে সোনার প্রতিমা কবরে দিলাম গাড়ি,
দাদু!
ধর- ধর- বুক ফেটে যায়, আর বুঝি নাহি পারি।
এইখানে
এই কবরের পাশে আরও কাছে আয় দাদু,
কথা
কস নাকো, জাগিয়া উঠিবে ঘুম-ভোলা মোর যাদু।
আস্তে
আস্তে খুঁড়ে দেখ দেখি কঠিন মাটির তলে,
দীন
দুনিয়ার ভেস্ত আমার ঘুমায় কিসের ছলে!
ওই
দুর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবীরের রাগে,
অমনি
করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।
মজিদ
হইতে আযান হাঁকিছে বড় সকরুণ সুর,
মোর
জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দূর।
জোড়হাতে
দাদু মোনাজাত কর, 'আয় খোদা! রহমান!
ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যু-ব্যথিত-প্রাণ।