মোতাহের হোসেন চৌধুরী রচিত ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধের মূল বক্তব্য

 ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু /  মূলবক্তব্য / মূলভাব

 
বাংলাদেশের যে কজন প্রাবন্ধিক যুক্তিনিষ্ঠ ও মননশীল প্রবন্ধের ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-১৯৫৬) তাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর রচিত ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধটি একটি অনন্য কীর্তি। এ প্রবন্ধে তিনি ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে এক ভিন্নধারার মতামত প্রকাশ করেছেন এবং উভয়ের মধ্যে পার্থক্য ও সাদৃশ্য তুলে ধরেছেন। আমরা এখানে প্রবন্ধের আলোচিত বিষয়গুলোকে আরও সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করব।
 
 
মানবজীবনে চক্ষু ও শ্রবণেন্দ্রিয়ের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সংস্কৃতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও শ্রবণশক্তিকে বিকশিত করতে চাইলেও ধর্ম প্রায়শই তা সীমাবদ্ধ করে। ধর্ম সত্যের উপলব্ধি ও যুক্তির অনুশীলনে সংযম আরোপ করে, যা এক ধরনের বাধা হিসেবে কাজ করে। তবে সংস্কৃতিবান মানুষ সত্যের সন্ধানে এবং যুক্তির আলোকে অগ্রসর হন। মানবসমাজের অর্ধাংশ, অর্থাৎ নারী, সংস্কৃতির অংশ হিসেবে অবহেলিত হতে পারে না; বরং নারী সংস্কৃতির অপরিহার্য উপাদান, কারণ সুর ও সৌন্দর্যের অন্যতম উৎস নারী। নারীতে কামনা রয়েছে—এটি অস্বীকারের বিষয় নয়।  
 
তবে সংস্কৃতির দৃষ্টিতে, কামের তুলনায় প্রেম এবং ভোগের চেয়ে উপভোগই মুখ্য। অথচ ধর্ম নারীকে প্রায়শই পাপের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করে। সমাজও মূল্যবোধের রক্ষার অজুহাতে নারীর ব্যক্তিত্ব বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু মানুষ তো সহজাতভাবে অজানাকে জানার এবং নিষিদ্ধকে অতিক্রম করার তাড়নায় পরিচালিত হয়। যেহেতু ধর্ম নারীর উপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে, তাই পুরুষের মধ্যে নারীভোগের প্রবণতা বেপরোয়া হয়ে ওঠে, যা শেষপর্যন্ত সামাজিক বিশৃঙ্খলা ডেকে আনে।  
 
সংস্কৃতির কাজ হওয়া উচিত—পুরুষ ও নারীর মধ্যে আরোপিত বৈরী সম্পর্ককে সহজতর করা। ধার্মিক ও মতবাদীদের মধ্যে মূলত কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই; উভয়েই মনে করেন, তাদের নিজস্ব ধর্ম বা মতবাদই একমাত্র সত্য, বাকিগুলো মিথ্যা। কিন্তু সংস্কৃতিবান ব্যক্তি প্রজ্ঞা ও যুক্তির আলোকে পরমতের মূল্যায়ন করেন এবং সেই আলোকে সভ্যতার প্রগতির দিশা অনুসন্ধান করেন।  
 
সুতরাং, সংস্কৃতিবান ব্যক্তি ধার্মিক বা মতবাদীদের তুলনায় অনেক বেশি গোঁড়ামিমুক্ত হন। প্রেমের সাধনার মাধ্যমেই সুসংস্কৃতি অর্জিত হয়, আর এই সাধনায় প্রত্যেকেই নিজের পথ খুঁজে নিতে পারেন। সৌন্দর্য, সত্য এবং জ্ঞানের পথে প্রেমই প্রথম ও প্রধান পথপ্রদর্শক। সংস্কৃতিবান ব্যক্তি ক্ষুধা নিবারণের জন্য বাঁচেন না; বরং মহত্তর জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে আহার গ্রহণ করেন। প্রগতি ও সভ্যতা এক নয়—যদিও অনেকেই এ দুটিকে অভিন্ন বলে মনে করেন।  
 
উৎপাদন প্রগতির সঙ্গে সম্পর্কিত, তবে এর মধ্যে সৌন্দর্য ও কল্যাণের স্থান প্রয়োজনীয় নয়। কিন্তু সভ্যতা হলো প্রগতি, সৌন্দর্য, কল্যাণ এবং প্রেমের যথাযথ সমন্বয়। সংস্কৃতিবান ব্যক্তি স্বভাবতই সভ্যতার আকাঙ্ক্ষী হন। তবে সভ্যতার পাশাপাশি মূল্যবোধের পরিসরও জরুরি। সুদৃঢ় মূল্যবোধের ভিত্তিতে মানুষ সংস্কার থেকে মুক্তি লাভ করে।  
 
সংস্কার থেকে মুক্তি মানে কখনোই যথেচ্ছাচার নয়। তাই অবাধ যৌনাচার সংস্কৃতিবান মানুষের পক্ষে কাম্য হতে পারে না। কামনার স্থূলতার চেয়ে প্রেমের মহত্ত্বই তাদের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করে মানুষ পূর্ণতা লাভ করেন এবং মহৎ, সুন্দর, সার্থকভাবে বেঁচে থাকেন—বিবেক জাগ্রত করে, প্রেমময় হয়ে।
 
জীবনের যথার্থ নিয়ন্ত্রণই হলো ধর্ম। সবকিছুরই একটি ধর্ম বা স্বভাব থাকলেও, মানুষের ধর্ম সেসবের চেয়ে আলাদা, কারণ তা বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। মানুষের ধর্মে লাভ ও লোভের বিষয়টি প্রবলভাবে প্রতিফলিত হয়। ধর্ম মানুষকে পাপ ও অন্যায় থেকে বিরত রাখে এবং পারলৌকিক মুক্তির আশায় সাধারণ মানুষ ধর্মের নিয়ম মেনে চলে। এ কারণে ধর্মকে তারা তাদের সংস্কৃতি হিসেবে গ্রহণ করে, আর শিক্ষিত মানুষের জন্য ধর্ম মানে উন্নত জীবনযাপনের রীতি।  
 
সংস্কৃতির মূল কথা হলো সত্য ও সৌন্দর্যের প্রতি প্রেম। সংস্কৃতির আভিধানিক অর্থ 'কৃষ্টি', যা বিনা স্বার্থে এবং নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় প্রকাশ পায়। এটি মানুষের নিজস্ব ত্যাগের মাধ্যমে জীবনের সৌন্দর্য ও মহত্ত্বকে উপলব্ধি করার প্রচেষ্টা। প্রকৃতি ও মানবজীবনের ভেতরে লুকানো অনুভূতিগুলোর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে সংস্কৃতি বেঁচে থাকার পথ তৈরি করে। কাব্য পাঠের আনন্দ, ফুলের সৌন্দর্য, নদীর স্রোতের সুর, কিংবা চাঁদের আলোয় বেঁচে থাকার এই পথই সংস্কৃতি।  

নিভৃত বাংলার আপডেট পেতে Google News এ Follow করুন
 
সংস্কৃতির প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো জীবনের মূল্যবোধকে উপলব্ধি করা। সংস্কৃতিবান মানুষের লক্ষ্য হলো নিজের ভেতরে সৃষ্টিকর্তার মহিমা সৃষ্টি করা। ধর্ম যদিও পাপ ও পতন থেকে মানুষকে রক্ষা করার চেষ্টা করে, তা মূলত ভয় এবং লোভের মাধ্যমে মানুষকে দুর্বল করে ফেলে। এ কারণে সাধারণ মানুষ অজ্ঞাতসারে ধর্মের বাণী মেনে চলে এবং স্বার্থের বশবর্তী হয়ে নিষ্ঠুরতম কাজ করতেও দ্বিধা করে না। বুদ্ধিজীবী জর্জ বার্নার্ড শ’ যথার্থই বলেছেন: “Beware of the man whose God is in the skies”— অর্থাৎ যার ঈশ্বর কেবল আকাশে, তার থেকে সাবধান।  
 
ধর্মে পাপের জন্য কঠোর শাস্তি আর পূণ্যের জন্য লোভনীয় পুরস্কারের প্রলোভন দেওয়া হয়। এতে মানবতার প্রকৃত বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, কারণ ধর্ম জীবনের সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করে শুধু নিষেধাজ্ঞা আরোপেই মনোনিবেশ করে। সাধারণ মানুষ জীবনের সহজ স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলোকে দমন করে পার্থিব সুখের পাশাপাশি মৃত্যুর পরেও স্বর্গীয় সুখের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। এ কারণে ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তিতে তারা ভয় পায় এবং তা এড়িয়ে চলে।  
 
সংস্কৃতিবানদের কাজ হলো বাইরের কোনো মতবাদ গ্রহণ না করে, আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে নিজস্ব জীবনদর্শন সৃষ্টি করা এবং তা ক্রমাগত উন্নতির পথে চালিত করা। সংস্কৃতি মানুষকে প্রেম, সৌন্দর্য, আনন্দ ও কল্যাণ সম্পর্কে সচেতন করে এবং সঠিক পথের দিশা দেয়। সংস্কৃতিবান ব্যক্তি সত্য ও ন্যায়ের পথে এগিয়ে গিয়ে মহৎ হৃদয়ের অধিকারী হয়ে ওঠেন। তিনি মতবাদীর মতো বুলি আওড়ান না; নিজের সৃষ্ট পথে নিজেই নবী হয়ে ওঠেন। প্রেম ও সৌন্দর্যের সাধনাই তার লক্ষ্য, আর এ জন্যই বলা হয়: “Man cannot live by bread alone”।  
 
সংস্কৃতিসাধনা মানে পরিপক্ব হওয়ার সাধনা, যেখানে মানুষ প্রেমের সাগরে নিমগ্ন হয়ে জীবনের সৌন্দর্য, বৈচিত্র্য এবং মহত্ত্বের পথ খুঁজে পায়। লেখক সার্থকভাবে বলেছেন: “সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীরে স্নাত না হলে সংস্কৃতিবান হওয়া যায় না।”  
 
ধর্ম সাধারণত ইন্দ্রিয়সাধনার বিরোধিতা করে, কিন্তু সংস্কৃতিবান ব্যক্তি ইন্দ্রিয়ের পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে জীবনের গভীরতাকে উপলব্ধি করেন। ধার্মিক ও মতবাদীরা প্রায়ই নিষ্ঠুর এবং আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেন, কারণ তারা ভয় ও লোভ দ্বারা পরিচালিত হন। অপরদিকে, সংস্কৃতিবান ব্যক্তি আত্মার ডাকে সাড়া দিয়ে নিজের ‘আমি’-কে প্রকাশ করেন। তার জীবন মুক্তচিন্তার অসংখ্য পথে পরিচালিত হয় এবং কোনো বন্ধনে আবদ্ধ থাকে না। তিনি উদার আকাশের মতো, যেখানে জীবনের মূল্যবোধের ধারণাই তার কাছে সব থেকে বড়।


Next Post Previous Post
1 Comments
  • Anonymous
    Anonymous May 6, 2025 at 1:54 AM

    স্যার আপনাকে কিভাবে ধন্যবাদ দেবো তা বলতে বা দেখাতে পারলেও ঋণ শোধ হবে না। আমাদের কালকে ১ম বর্ষের ২য় সেমিস্টারের ফাইনাল পরিক্ষা এ প্রবন্ধ গুলো সচরাচর বই এ পাওয়া যায় না গেলেও এখন কেন সম্ভব না। আপনার দ্বারা আমি কি যে উপকৃত হয়েছি স্যার অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।ডিগ্রি বা অনার্সের আরো কবিতা,গল্প,প্রবন্ধ সিলেবাস অনুযায়ী দেয়ার চেষ্টা করবেন স্যার।
    ৬/৫/২০২৫

Add Comment
comment url