দিলিরিস আরতুগুল: কিছু কথা, কিছু সতর্কতা
১.
কাজের সূত্রে একটা অফিসে প্রায়ই যেতাম। অফিসের স্টাফেরা প্রায় সবাই বয়সে তরুণ।
খেয়াল করতাম অবসর সময়ে তারা একত্রিত হয়ে কথা বলা শুরু করতেন। হালিমা, আইকিচ, তারগুত, আরতুগুল, গুনদারো, সেলচান...নানা শব্দ কানে আসতো। নিজেরা নিজেরা এই সব চরিত্র নিয়ে অনেক কথা বলতেন। কোন ধারণা না থাকায় এসব কিছুই ভিন দেশি ভাষার মতই আমার কানে দুর্বোধ্য ঠেকত।
একদিন একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন “ভাই কি দিরিলিস দেখেন?”
আমি মাথা নাড়লাম “না। কি সেটা?”
বেচারা আমার দিকে এমন চোখে তাকালেন, যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখছেন।
কোয়ারান্টাইন পিরিয়ডে খেয়াল করলাম, দিরিলিস নিয়ে মানুষের মধ্যে দারুণ ক্রেজ। বিদেশে থাকা আমার এক কাজিন আমাকে পরামর্শ দিলেন, আমি যেন দিরিলিস অবশ্যই দেখি। একজন মুসলিম হিসেবে এটা দেখা আমার অবশ্য কর্তব্য।
আরেক কাজিন কয়েক দিনেই এক সিজনের সব পর্ব দেখে শেষ করে ফেলেছে। পুরো সিরিয়াল নাকি মারাত্মক এডিক্টিভ। দেখা শুরু করলে আর ছাড়া যায় না। এডিকশনের ভয়ে আপাতত আর পরের সিজন দেখছে না।
ফেসবুকেও অনেকে দেখলাম, দিরিলিস নিয়ে আবেগঘন পোস্ট দিচ্ছেন। বিভিন্ন পর্বের লিঙ্ক শেয়ার করছেন।
জনগনের এত ক্রেজ দেখে কৌতূহল জাগল। ভাবলাম, কি এমন জিনিস যার জন্য সবাই এমন মাতোয়ারা!
.
২.
উসমানী খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা ওসমান গাজির পিতার নাম আরতুগুল।
একটা ছোট যাযাবর গোত্রকে তিনি রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তার স্থাপন করা ভিত্তির উপর দাড়িয়েই তার তৃতীয় ছেলে উসমানের হাত ধরে উসমানী খিলাফতের জন্ম হয়।
দিরিলিস মূলত আরতুগুলের কাহিনী। দিরিলিস তুর্কী ভাষার শব্দ। যার অর্থ হল পুনরুজ্জীবন।
আরতুগুলের পিতা সোলেমান শাহ ছিলেন যাযাবর কায়ী গোষ্ঠীর নেতা। তুর্কী এ যাযাবর গোষ্ঠী এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াত। তাদের নিজস্ব কোন ভূখণ্ড ছিল না। পশু পালন, গৃহস্থালি পণ্যের উৎপাদন ও বিপণন, ব্যবসা ছিল তাদের আয়ের প্রধান উৎস।
সুলেমান শাহের তৃতীয় পুত্রের নাম আরতুগুল। আরতুগুল একদিকে ছিল উচ্চাভিলাষী, অন্যদিকে স্বপ্নবাজ ও বীর যোদ্ধা। আরতুগুল স্বপ্ন দেখত, একদিন তাদেরও নিজস্ব ভূখণ্ড হবে। তুর্কী জাতিগোষ্ঠীগুলোর স্বাধিকার থাকবে, সার্বভৌমত্ব থাকবে।
আরতুগুলের স্বপ্ন বাস্তবায়নে নানা মুখি বাধা বিপত্তি, সংঘাত, সংঘর্ষ, বিরোধকে নিয়েই নির্মিত হয় সিরিয়াল দিলিরিস।
সিরিয়ালের কাহিনী বিন্যাস, মেকিং, অভিনয়, নির্মাণ, পরিচালনা বেশ মানসম্মত। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ফিউশনে তৈরি মিউজিকের যথাযথ ব্যবহার কাহিনীকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
.
৩.
দিলিরিস নিয়ে আমাদের যুব সমাজের মধ্যে ক্রেজের কমতি নেই।
সিনেমা নাটক নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্রেজ থাকা নতুন কিছু নয়। তবে দিলিরিস নিয়ে মাতামাতির মাত্রাটা অন্যরকম।
এই মাতামাতির মধ্যে যেমন আবেগ আছে,ভাল লাগা, ভালবাসা আছে, ঠিক তেমনি চিন্তা চেতনায় বেশ কিছু ভুলও আছে
ক. হালাল হারাম প্রসঙ্গ:
আলিমরা এই সিরিয়াল দেখাকে হারাম ঘোষণা করেছেন। কিন্তু দিরিলিস ভক্তরা আলিমদের এই সিদ্ধান্তে নাখোশ। অনেকে আলিমদের গালি দিচ্ছেন। অনেকে তাদেরকে ব্যাকডেটেড, কূপমণ্ডূক বলে আখ্যায়িত করছেন।
ইসলামী শরীয়তে হালাল হারামের বিধান সুস্পষ্ট নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। সেই সব নীতির আলোকে দিলিরিসকে হালাল বলার কোন সুযোগ নেই। কুরআন হাদিসের উপর পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন, এমন কোন মুহাক্কীক ফকিহ তাকে হারামই বলবেন, হালাল বলবেন না।
এই সিরিজে নারী চরিত্রের উপস্থাপন, মিউজিকের ব্যবহার, নায়ক নায়িকা ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ, স্পর্শ আলিঙ্গন সহ এমন কিছু বিষয় আছে যা ইসলামী শরীয়তে অনুমোদিত নয়।
এটা ঠিক, বলিউড হলিউডের মুভি কিংবা জি বাংলা সিরিয়ালের চাইতে এই সিরিজে হারামের পরিমাণ কম। পাশাপাশি এর মধ্যে শিক্ষণীয় ও কল্যাণকর কিছু বিষয় আছে। কিন্তু, কিছু কল্যাণকর বিষয়ের উপস্থিতি থাকাটা কোন বিষয়কে হালাল করে না।
পৃথিবীতে এমন কোন বিষয় হয়তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না, যার মধ্যে কোণ কল্যাণ নেই। কুরআনে আছে, মদ জুয়ার মধ্যেও মানুষের জন্য কল্যাণ আছে। কিন্তু তার মধ্যে থাকা অকল্যাণ কল্যাণের চাইতে অনেক অনেক গুণ বেশি। তাই ইসলামে শরীয়তে মদ জুয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তাই, দিরিলিস ভক্তদের বলি, এই সিরিজ দেখতে চাইলে আপনি নিজ দায়িত্বে দেখবেন। কিন্তু, তাই বলে তাকে হালাল বানাতে যাবেন না। কোন হারাম জিনিসকে হালাল মনে করা হারামে লিপ্ত হবার চেয়েও বড় অপরাধ, বড় পাপ।
হালাল হারাম কারও ব্যক্তিগত ভাল লাগা মন্দ লাগার উপর নির্ভর করে না। আলিমদের দায়িত্ব হল শরীয়তের বিধি বিধান মানুষের সামনে তুলে ধরা। তারা সে কাজটিই করছেন। কিন্তু, তার জন্য তাদেরকে ব্যাকডেটেড, কূপমণ্ডূক বলে হেয় করা ঈমানের পরিপন্থী একটা কাজ।
অনেকে যুক্তি দেখান, মানুষ এখন ভারতীয় সিরিয়াল দেখছে, হলিউড বলিউডের সিনেমা দেখছে। এসময়ে দিলিরিসের মত সিরিয়ালকে উৎসাহিত করা উচিৎ। হারাম হারাম বলে দিলিরিসকে দূরে ঠেলে দেয়া বোকামি।
কিন্তু এই যুক্তিও দুর্বল। আলিমরা সব সিরিয়াল মুভিকেই হারাম বলেন। যারা হারাম হালাল মানেন, তারা হলিউড বলিউড ঢালিউড সব কিছু থেকেই দূরে থাকেন। দিলিরিস না কি বলিউড, কোনটার মধ্যে পাপ কম, তা নিয়ে তারা মাথা ঘামান না।
আর যারা দিলিরিস দেখেন, তারা অন্য নাটক সিনেমাও দেখেন। নাটক সিনেমার নিয়মিত দর্শকেরা পাপ পুণ্যের বিচার করে কোন মুভি/সিরিয়াল/নাটক দেখতে বসেন না। নিজেদের ভাল লাগাকেই তারা প্রাধান্য দেন।
খ. ইতিহাস প্রসংগঃ
অনেক দিলিরিস ভক্তই মনে করেন, সিরিয়ালে দেখানো সব বিষয়ই ইতিহাসের অংশ। অনেকেই সিরিয়াল দেখে ইতিহাস শিখতে চান।
কিন্তু এই ধারণা আগাগোড়াই ভুল।
এই ধরনের সিরিয়ালগুলো ঐতিহাসিক পটভূমিতে নির্মিত। কিন্তু এর সব কিছুই ইতিহাস নয়।
একটা মজার তথ্য দেই। দিরিলিসের নায়ক, নিজেই বলেছেন 'এরতূগাল সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। তার সম্পর্কে প্রাপ্ত ইতিহাস বড়জোর সাত পাতার বেশি হবে না'
তাহলে সাত পাতার লিখিত ইতিহাস থেকে ১৫০ পর্বের (প্রতি পর্ব ২ ঘণ্টা) বিশাল সিরিয়াল হয় কি করে?
এখানে ফ্যাক্ট ৫% হলে বাকি ৯৫% ই ফিকশন। সিরিয়াল মূলত বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান। এ ধরনের অনুষ্ঠানে ঐতিহাসিক ব্যাকড্রপ ঠিক রেখে নিজের মত করে কাহিনী সাজানো হয়।
নির্মাতারাও একে ফিকশন বলেন। এ থেকে ইতিহাস শিখতে যাওয়া খড়ের গাদায় সুচ খুঁজতে যাওয়ার মত।
গ. ইসলামিক সিরিয়াল:
আমাদের অনেক মুসলিম ভাইদের মধ্যেই ভাবাবেগ কাজ করে। তারা যে কন কিছুকেই ইসলামিক রূপ দিতে চান।
কিছু লোক আছে, বিজ্ঞানের যে কোন নব আবিষ্কার পেলেই কুরআনের সাথে তার মিল দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেকে নতুন ও জনপ্রিয় যে কোণ তত্বকেই ইসলামিক বলে আখ্যায়িত করেন।
এই যেমন, কোন এক সময় এই দেশে ‘ইসলামী সমাজতন্ত্রে’র ধারনা বেশ আলোচিত হয়েছিল। আজকাল মেডিটেশনের ভক্ত অনেক ভাই হাদিস কুরআন দিয়ে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন, মেডিটেশন সম্পূর্ণ ইসলামিক। তারা বলেন, এমন কি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও হেরা গুহায় বসে মেডিটেশন করেছেন (!!??_)
এমন মানসিকতার ছাপ দেখা যায়, দিলিরিস সিরিয়ালের ক্ষেত্রেও। অনেক ভাই এই সিরিয়ালকে ইসলামিক সিরিয়াল মনে করেন।
সিরিয়ালের চরিত্রেরা কথায় কথায় আল্লাহ্র নাম স্মরণ করেন, আল্লাহ্র উপর ভরসা রাখেন। যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত, বিজয়ীদের ক্ষেত্রে শহীদ/গাজি উপাধি ব্যবহার করেন।
দিলিরিস মূলত তুর্কি জাতীয়তাবাদী সিরিয়াল। আরতুগুল ও অন্যান্য চরিত্র তুর্কি জাতিগোষ্ঠীর স্থায়ী আবাস, তাদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে কাজ করেছেন। সিরিয়ালের মুখ্য বিষয়ও তাই।
কিছু চরিত্র কিছু ইসলামিক পরিভাষা ব্যবহার করে বলেই তুর্কি জাতীয়তাবাদী সিরিয়ালকে ইসলামী সিরিয়াল ভাবাটা ভুল। এভাবে ভাবলে বাংলা সিনেমাও সেমি ইসলামিক। কারণ বিপদে পড়লে বাংলা সিনেমার মা খালারাও ‘ইয়া আল্লাহ!’ বলে চিৎকার দেন।
কিছু চরিত্রের মুখে কিছু ইসলামিক পরিভাষা উচ্চারিত হলেই, তাকে ইসলামিক উপাধি দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়া অযৌক্তিক।
.
৪.
সার্বিক বিচারে “দিলিরিসঃ এরতুগুল” অত্যন্ত উপভোগ্য একটা সিরিজ।
কিন্তু এই সিরিয়াল দেখতে গেলে কিছু সতর্কতা মাথায় রাখা চাই।
মনে রাখতে হবে সিরিয়াল সিরিয়ালই, ইতিহাস নয়। সত্যিকারের ইতিহাস সিরিয়াল/নাটক/সিনেমার মত এত আকর্ষণীয়, এত চমৎকার হয় না।
বাস্তবের ইতিহাসে বিনোদনের এত মাল মশলা মজুদ থাকেনা।
বাস্তবের নায়কেরা সিরিয়ালের নায়কের মত একাই একশত জনকে শুইয়ে ফেলার মত যোগ্যতা রাখেন না।
আবেগ মানুষেরই থাকে।
কিন্তু অতিরিক্ত ভাবাবেগ মানুষের জন্য ক্ষতিকর। সে ভাবাবেগে ভেসে গিয়ে আলেম উলামাদের অযৌক্তিক সমালোচনা করা কিংবা দিলিরিসের বিরোধীতাকারী সবাইকে শত্রুর কাতারে ফেলে দেয়া নিতান্তই অনুচিত কাজ।
আশা করি, দিলিরিস ভক্তরা সে কথা মাথায় রাখবেন।
লেখায়- শামসুর রহমান ওমর