মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য: অন্নদামঙ্গল কাব্য

অন্নদামঙ্গল কাব্য

দেবী অন্নদার গুণকীর্তন রয়েছে অন্নদামঙ্গল কাব্যে। অন্নদামঙ্গল কাব্যের প্রধান কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর। তিনি মধ্যযুগের সর্বশেষ কবি । ভারতচন্দ্রের মাধ্যমেই মধ্যযুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। ভারতের হাওড়া জেলার পেঁড়ো গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নবদ্বীপের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ছিলেন। মহারাজকে কবিতা রচনা করে শোনানোই তাঁর প্রধান কাজ। অন্নদামঙ্গল কাব্য রচনা করার জন্য মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে 'রায় গুণাকর' উপাধি প্রদান করেন । তাকে নাগরিক কবি বলে অভিহিত করা হয়। 

অন্নদামঙ্গল কাব্য

 

অন্নদামঙ্গল কাব্য তিন খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ড 'শিবনারায়ণ অন্নদামঙ্গল', দ্বিতীয় খণ্ড 'বিদ্যাসুন্দর কালিকামঙ্গল' এবং তৃতীয় খণ্ড 'ভবানন্দ-মানসিংহ অন্নদামঙ্গল' নামে পরিচিত। ১৭৬০ সালে ভারতচন্দ্রের মৃত্যু হয়।

অন্নদামঙ্গল কাব্যের প্রথম খণ্ডের উপাখ্যানে সতীর দেহত্যাগ ও উমারূপে জন্মগ্রহণ, শিবের সঙ্গে বিয়ে ও ঘরকন্যা, অন্নপূর্ণা মূর্তিধারণ, কাশী প্রতিষ্ঠা, ভবানন্দের জন্মকাহিনী, হরিহোড়ের দ্বিতীয় পক্ষে তরুণী ভার্যা গ্রহণে বিচলিত দেবীর হরিহোড়ের গৃহত্যাগ এবং ভবানন্দের প্রতি অনুগ্রহ করার উদ্দেশ্যে ভবানন্দ-গৃহে যাত্রা - প্রভৃতি বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডের প্রধান বিষয় বিদ্যাসুন্দরের প্রণয়কাহিনী। এটি কালিকামঙ্গলের প্রচলিত কাহিনী - বিদ্যা ও সুন্দরের গুপ্ত প্রণয়লীলা ও মিলনের বৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে। তৃতীয় খণ্ডের কাহিনী কবি ইতিহাস থেকে সংগ্রহ করলেও তা সত্যাশ্রয়ী নয় । এ খণ্ডে মানসিংহের যশোর গমন, দেবীর অনুগ্রহে ভবানন্দ মজুমদারের সাহায্যে রাজা প্রতাপাদিত্যের পরাজয়, বাদশাহের খেলাত লাভের উদ্দেশ্যে ভবানন্দের দিল্লী গমন এবং বাদশাহ কর্তৃক কারারুদ্ধ, কারাগারে ভবানন্দের দেবী উপাসনা, দেবী কর্তৃক দিল্লীতে উৎপাত, বাদশাহ কর্তৃক ভবানন্দের মুক্তি ও রাজা উপাধি প্রদান - এ কাহিনীই বর্ণিত হয়েছে।

অন্নদামঙ্গলের উল্লেখযোগ্য চরিত্র- মানসিংহ, ভবানন্দ, বিদ্যা, সুন্দর, মালিনী ইত্যাদি।

(এছাড়া ভারতচন্দ্র 'সত্য নারায়ণ পাঁচালী', 'রসমঞ্জুরী' (অনুবাদ), চণ্ডীনাটক প্রভৃতি রচনা করেন। রসমঞ্জুরী কাব্যটি ভারতচন্দ্র মৈথিলি ভাষা থেকে অনুবাদ করেন। কাব্যটির মূল রচয়িতা ভানু দত্ত। ভারতচন্দ্রের অসমাপ্ত নাটকের নাম 'চণ্ডীনাটক'। ভারতচন্দ্রের সংস্কৃত ভাষায় রচিত দুটি কবিতা হলো ‘নগাস্টক' ও ‘গঙ্গাস্টক’।)

অন্নদামঙ্গলের বিখ্যাত পঙ্ক্তি;

  1. আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।
  2. নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?
  3. মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন ।
  4. বড়র পিরীতি বালির বাঁধ! ক্ষণে হাতি দড়ি, ক্ষণেকে চাঁদ
  5. মাতঙ্গ পড়িলে গড়ে পতঙ্গ প্রহার করে।
  6. হাভাতে যদ্যপি চায় সাগর শুকায়ে যায়।
  7. বাপে না জিজ্ঞাসে মায়ে না সম্ভাষে ।
  8. বাঘের বিক্রম সম মাঘের শিশির।
  9. হাভাতে যদ্যপি চায় সাগর শুকায়ে যায়।

অষ্টাদশ শতকে এসে মঙ্গলকাব্যের ধারা ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়। এরই মধ্যে অসাধারণ কাব্য রচনা করেন ভারতচন্দ্র রায়। তিনখণ্ডের এ কাব্যের নাম অন্নদামঙ্গল। অন্নদার কথা থাকলেও এ কাব্য রচনার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারের গৌরব বর্ণনা করা । কৃষ্ণচন্দ্ৰ এই কাব্য দিয়ে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, এই কাব্য তাঁর দরবারে গাওয়া হয়েছিলো। তাছাড়া এ কাব্য রচনার পর কৃষ্ণচন্দ্র বর্তমান আকারে কালীপূজা প্রবর্তন করেন।

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url