রোমান্সধর্মী প্রণয়োপাখ্যান
মুসলমান কবিগণ মধ্যযুগে রোমান্টিক প্রণয়কাব্য রচনার মাধ্যমে বাংলা
সাহিত্যে প্রত্যক্ষ অবদান রাখতে সক্ষম হন। হিন্দি এবং
আরবি- ফারসি সাহিত্যের উৎস হতে উপকরণ নিয়ে রচিত প্রণয়কাব্য গুলোতে
মানবীয় বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়েছে। প্রণয়োপাখ্যানগুলোর মধ্যে ইউসুফ-
জোলেখা, লাইলী-মজনু, হানিফা ও কয়রাপরী, সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল,
জেবলমুলক-শামারোখ প্রভৃতি কাব্যের কাহিনী ফারসি সাহিত্য থেকে এবং গুলে
বকাওলী,
সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী, পদ্মাবতী, মধুমালতী, গদামল্লিকা প্রভৃতি
কাব্যের কাহিনী হিন্দি সাহিত্য থেকে গৃহীত।
শাহ মুহম্মদ সগীর
পনের শতকের কবি শাহ মুহম্মদ সগীর রচনা করেন 'ইউসুফ জোলেখা' কাব্য।
তিনি মধ্যযুগের প্রথম মুসলিম কবি ও ইউসুফ জোলেখা কাব্যের প্রথম কবি।
বাইবেল ও কুরআন শরীফে নৈতিক উপাখ্যান হিসেবে এ প্রণয়কাহিনী বর্ণিত
হয়েছে। ইরানি কবি ফেরদৌসীর ইউসুফ জোলেখা কাব্যের রোমান্টিক ভাবধারার সাথে
শাহ মুহম্মদ সগীরের
কাব্যের যথেষ্ট সামঞ্জস্য রয়েছে। কুরআন ও ফেরদৌসীর কাব্য ব্যতীত মুসলিম
কিংবদন্তী ও স্বীয় প্রতিভার উপর নির্ভর করে শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁর 'ইউসুফ
জোলেখা' কাব্য রচনা করেন।
এ কাব্যের কাহিনী মিশরের। অনেকের মতে তিনি ফারসি কবি জামী রচিত ফারসি
প্রেমাখ্যান 'ইউসুফ ওয়া জুলয়খা' অবলম্বনে রচনা করেন
'ইউসুফ জোলেখা' কাব্য। তবে কবি জামী শাহ মুহম্মদ সগীরের পরবর্তী কবি
হওয়ায় জামীর কাব্য অনুসরণ করার সম্ভাবনা খুবই কম।
কাব্যটি গৌড়ের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের রাজত্বকালে রচিত হয়।
এ কাব্যের মূল বিষয়বস্তু হলো- তৈমুর বাদশাহ-কন্যা জুলেখা এবং ক্রীতদাস
ইউসুফের প্রণয় কাহিনী।
ইউসুফ জোলেখা কাব্যের অধ্যায় বা সর্গশীর্ষে সর্বত্র ছন্দের ও বেশির ভাগ
ক্ষেত্রে রাগতালের উল্লেখ আছে।
কাব্যে ঊনসত্তরটি শিরোনাম ব্যবহৃত হয়েছে। কাব্যের মধ্যে মধ্যে গান
রয়েছে। 'ধুয়া'সহ এরূপ ছয়টি গানের স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। তবে ইউসুফ
জোলেখা কাহিনী কাব্য, গীতি কাব্য নয়।
ইউসুফ জোলেখা কাব্যের কাহিনী
তৈমুর বাদশাহ দেবধর্ম আরাধনা করে এক কন্যারত্ন লাভ করেন;
তাঁর নাম রাখেন জোলেখা। অসামান্য সুন্দরী জোলেখা পর পর তিনবার দেবতুল্য এক
যুবাপুরুষকে স্বপ্নে দেখে তাঁর প্রণায়াসক্ত হন। স্বপ্নের নির্দেশমতো
জোলেখা মিশরের বাদশাহ আজিজ মিশিরকে বরমাল্য দিলেন, কিন্তু আজিজ মিশির
স্বপ্নদৃষ্ট ব্যক্তি ছিলেন না। দৈববাণী কর্তৃক আশ্বাস লাভ করে জোলেখা
ভারাক্রান্ত মন ও প্রণয়পীড়িত দেহ নিয়ে কালযাপন করেন। এদিকে কেনান দেশের
ইয়াকুব নবীর পুত্র ইউসুফের ভবিষ্যৎ সৌভাগ্যে ও কৃতিত্বে ঈর্ষাকাতর
বৈমাত্রেয় দশ ভ্রাতা তাঁকে কূপে নিক্ষেপ করে হত্যা করার চেষ্টা করে। মনিরু
নামে মিশরবাসী এক বণিক ইউসুফকে কূপ থেকে উদ্ধার করে মিশরে নিয়ে যান এবং
দাসরূপে বিক্রয় করেন। জোলেখার অনুরোধক্রমে আজিজ মিশির তাঁকে খরিদ করেন এবং
নিজ অন্তঃপুরে নিয়ে যান। ইউসুফের রূপমুগ্ধ জোলেখা প্রেমনিবেদন করলে ইউসুফ
ধর্মভয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। জোলেখা ছল প্রতারণা করে ইউসুফকে কারাগারে
নিক্ষেপ করেন। কিন্তু কিছুকাল পরে আজিজ মিশিরের স্বপ্ন ব্যাখ্যা করে ইউসুফ
মুক্তিলাভ করেন এবং মিশরের মন্ত্রিত্ব পান। ইউসুফ দক্ষতার সাথে রাজকার্য
পালন করেন এবং আজিজ মিশিরের মৃত্যুর পর তিনিই মিশরের সর্বময় ক্ষমতা ও
কর্তৃত্বের অধিকারী হন। জোলেখা বৃদ্ধ ও অন্ধপ্রাপ্ত হয়ে ইউসুফের সাক্ষাতের
আশায় পথে অপেক্ষা করতে থাকেন। পরিশেষে একদিন সাক্ষাৎ হয় এবং ইউসুফের
প্রার্থনায় জোলেখা হৃতযৌবন ও রূপসৌন্দর্য ফিরে পান। উভয়ে বিবাহ-বন্ধনে
আবদ্ধ হন। যথাসময়ে তাঁরা দুটি পুত্রসন্তান লাভ করেন।
পরপর কয়েক বছর অনাবৃষ্টির কারণে চতুর্দিকে মহাদুর্ভিক্ষ
দেখা দিলো। ইয়াকুব নবী উপায়ন্তর না দেখে স্বীয় পুত্রদের খাদ্যের
সন্ধানে মিশরে প্রেরণ করেন। ইউসুফ অত্যাচারী ভ্রাতাদের চিনতে পারেন, কিন্তু
পরিচয় গোপন করে তাঁদের আদর-আপ্যায়ন করেন এবং প্রচুর খাদ্যশস্য দিয়ে
বিদায় করেন। তাঁরা ইবনে আমিনকে নিয়ে দ্বিতীয়বার মিশরে গেলে ইউসুফ কেবল
সহোদর আমিনকে নিজ পরিচয় দেন এবং ছলে ‘সোনার কাঠা’ চুরির অপবাদ দিয়ে বন্দী
করে নিজের কাছে রাখেন। পিতা ইয়াকুবকে মিশরে আনার জন্য দ্রুতগামী অশ্ব
দিয়ে বৈমাত্রেয় ভ্রাতাদের বিদায় করেন। ইয়াকুব মিশরে উপনীত হলে ত্রিশ
বছর পর পিতা-পুত্রের মিলন হয়। ইউসুফ ভ্রাতাদের রাজকীয় দায়িত্ব দিয়ে
মিশরে রাজত্ব করেন। কিছুকাল পরে বারহা- তনয়ার সাথে জ্যেষ্ঠপুত্রের এবং
নৃপতি আমির-তনয়ার সাথে কনিষ্ঠপুত্রের বিবাহ দেন ৷ অতঃপর ইউসুফ দিগ্বিজয়ে
বের হন। অনেক রাজ্য জয়ের পর মৃগয়ার সময়ে মধুপুরের রাজা শাহাবালের
রূপবর্তী কন্যা বিধুপ্রভার সাক্ষাৎ পান। বিধুপ্রভার ঈপ্সিত পাত্ৰ ইবন
আমিনের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। অপুত্রক শাহাবাল জামাতাকে মধুপুর রাজ্য দান
করেন ৷ ইউসুফ মিশরে প্রত্যাবর্তন করেন। কিছুকাল পরে ইবন আমিন ও বিধুপ্রিয়া
মিশরে এসে বৃদ্ধ ইয়াকুবের পদবন্দনা করেন। জোলেখা বিধুপ্রভাকে বরণ করেন।
ইউসুফ মিশরে এবং ইবন আমিন মধুপুরে সুখে রাজত্ব করেন।
দৌলত উজির বাহরাম খান
ষোল শতকের কবি দৌলত উজির বাহরাম খান ফারসি কবি জামী রচিত ফারসি
প্রেমাখ্যান 'লায়লা ওয়া মজনুন' অবলম্বনে রচনা করেন 'লায়লী মজনু' কাব্য। এ
কাহিনীর মূল উৎস আরবী লোকগাঁথা। এর উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলো হলো - লাইলী,
কয়েস, নওফলরাজ, হেতুবতী।
সুফিতত্ত্বের রূপকে লায়লী মজনু কাব্য প্রথম রচনা করেন ইরানের কবি
নিজামী গঞ্জাভি ১১৮৮ খ্রিষ্টাব্দে। ইরানের অপর কবি আবদুর রহমান জামী একই
আদর্শে লায়লী মজনু প্রেমকাব্য রচনা করেন ১৪৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। ভারতের ফারসি
কবি আমির খসরু ১২৯৮ সালে উক্ত কাব্য রচনা করেন। ধারণা করা হয়, বাহরাম খান
জামীর কাব্যের অনুসরণ করেছিলেন। এটি বিরহের কাব্য ।
বাহরাম খান মধ্যযুগের বিখ্যাত কবি। তিনি চট্টগ্রামের 'নগর
ফতেয়াবাদ'র অধিবাসী ছিলেন। তাঁর পিতা মোবারক খান চট্টগ্রামের অধিপতি নিজাম
শাহ সূর-এর কাছ থেকে দৌলত উজির (অর্থমন্ত্রী) উপাধি পেয়েছেন। অল্পবয়সে
বাহরাম খান পিতৃহীন হলে বাহরাম খান পিতৃপদ না পেলেও ১৫৬০ সালে ঐ উপাধি লাভ
করেন। কবির পূর্বপুরুষ হামিদ খান গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহের প্রধান উজির
ছিলেন। তিনি সুলতানের কাছ থেকে 'দুই সিক' ভূমির জায়গীর লাভ করেন। বাহরাম
খান পীরভক্ত ছিলেন; আসাউদ্দিন ছিলেন তাঁর পীর। তিনি ভণিতায় বহুবার পীরের
চরণশরণ কামনা করেছেন। পীর কবির প্রেরণাদাতা, কিন্তু কাব্যের পাঠক রাজপুরুষ।
কবির 'লায়লী মজনু' কাব্যে পীর ও সুলতানের প্রতি আনুগত্যের প্রতিফলন
রয়েছে।
বাহরাম খানের অপর কাব্য হলো ইমাম বিজয়। এটি কারবালার বিষাদময় কাহিনী
অবলম্বনে রচিত।
লায়লী-মজনু কাব্যের কাহিনী
আরবের এক ধনী আমির বহু দয়া-ধ্যান করে একটি পুত্রসন্তান
লাভ করেন, তার নাম রাখেন কয়েস। পাঠশালায় পড়ার সময়ে মালিক নন্দিনী
লায়লীর সাথে কয়েসের সাক্ষাৎ ও প্রণয় হয়। লায়লীর মাতা লায়লীর প্রেমকথা
জানতে পেরে কূল- কলঙ্কের ভয়ে তার পাঠ বন্ধ করে দেন এবং কয়েসের সাথে
সাক্ষাৎ বা পত্রবিনিময় যাতে না করতে পারে, তার জন্য সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ
করেন। বন্দিনী লায়লী কেবল বিলাপ ও অশ্রুপাত করে কালযাপন করে। এদিকে
প্রেমশরাহত কয়েস ভিখারীর ছদ্মবেশে লায়লীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসে ধরা
পড়ে এবং মালিকের নির্দেশে প্রহরী কর্তৃক নির্যাতিত হয়। লায়লীর প্রেম
ধ্যান করে কয়েস গৃহত্যাগ করে নজদ বনে আশ্রয় নেয়। প্রেমোন্মত্ত ও
বিরহকাতর কয়েসের নাম হয় 'মজনু' (পাগল)। আমির অনেক চেষ্টা করেও মজনুর
মতি-পরিবর্তন করতে পারেননি। গৃহে আত্মীয়-পরিজন-সহচরী পরিবেষ্টিত থেকেও
লায়লী বিরহ-যন্ত্রণা ভোগ করে ও অনবরত বিলাপ করে। আমিরের অনুরোধে মালিক
লায়লী মজনুর বিবাহে সম্মত হন, কিন্তু বিবাহবাসরে মজনুর প্রেমোন্মত্ততার
কারণে তা ভেঙে যায়। মজনু নজদ বনে ফিরে যায় এবং লায়লীর প্রেম ধ্যান করতে
করতে ঈশ্বরপ্রেমে মগ্ন হয়। আমির আশাভঙ্গে ও পুত্রশোকে প্রাণত্যাগ করেন।
ইবন সালামের পুত্রের সাথে লায়লীর বিবাহ হয় বটে কিন্তু বাসরঘরে লায়লীর
পদাঘাত পেয়ে নববর গৃহত্যাগ করে চলে যায়।
এক বৃদ্ধার মুখে মজনু লায়লীর বিবাহ-সংবাদ পেয়ে
‘হৃদয়শোণিতে' তাকে পত্র দেয়। লায়লীর পত্র পেয়ে মজনু শান্ত হয়।
নয়ফল-রাজ মৃগয়ায় এসে মজনুকে উদ্ধার করেন এবং মালিককে যুদ্ধে পরাভূত করে
লায়লীকে বন্দী করেন। পরে লায়লীর রূপে তিনি নিজেই বন্দী হন এবং বিষপান
করিয়ে মজনুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। সাকির প্রমাদে বিষমিশ্রিত পানীয় পান
করে নয়ফল-রাজ মৃত্যুবরণ করেন। পিতা লায়লীকে উদ্ধার করে নিয়ে যান।
কিছুকাল পরে পিতামাতার সাথে শামদেশে যাওয়ার পথে লায়লী নিজের উট চালিয়ে
নজদ বনে যায় এবং মজনুর সাথে মিলিত হয়। কলঙ্কের ভয়ে মজনু লায়লীকে
ফিরিয়ে দেয়। বিরহতাপানলে দগ্ধ হয়ে লায়লী মৃত্যুবরণ করে; শোকে মুহ্যমান
মজনুও লায়লীর কবরে বিলাপ করতে করতে প্রাণত্যাগ করে।
মুহম্মদ কবীর
ষোল শতকের কবি মুহম্মদ কবীর হিন্দি কবি মনঝন রচিত হিন্দি
প্রেমাখ্যান ‘মধুমালত' অবলম্বনে রচনা করেন ‘মধুমালতী' কাব্য। ড. এনামুল
হকের মতে, এটি ১৫৮৮ সালে রচিত।
মনঝন ১৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে 'মধুমালত' রচনা করেন। তিনি ছিলেন জনপ্রিয় কবি।
মনঝন সুফিসাধক ছিলেন। শেখ মুহম্মদ গওস তাঁর পীর ছিলেন। মুহম্মদ কবীর
‘লোকমন হরষিত' করার উদ্দেশ্যে এটি ভাষান্তর করেন।
বাংলা অনুবাদে সুফিতত্ত্বের ব্যঞ্জনা ফোটে নি। তবে বাংলা কাব্যে মানবিক
গুণ আছে।
মধুমালতী কাব্যের কাহিনী
কঙ্গিরা রাজ্যের রাজা সূর্যভান নিঃসন্তান ছিলেন। বহু
দানধর্ম করে রাজদম্পতি পুত্রসন্তান লাভ করেন; তার নাম মনোহর। বিদ্যাশিক্ষা
লাভ করে রাজকুমার বড় হলো । জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণী-অনুসারে মনোহর পনেরো
বছর বয়ঃক্রমকালে প্রেমের কারণে দেশান্তরী হয়। পরীরা ঘুমন্ত অবস্থায়
মনোহরকে হরণ করে তাদের রাজকন্যা মধুমালতীর কাছে নিয়ে যায়। মধুমালতীর পিতা
বিক্রম অভিরাম মহারস রাজ্যের অধিপতি ছিলেন। মনোহর ও মধুমালতী প্রথম
সাক্ষাতে পরস্পরের প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়। তারা পরস্পর অঙ্গুরি বিনিময় করে
এবং গান্ধর্ববিবাহে আবদ্ধ হয়ে সুরত ভোগ করে। নিদ্রিত অবস্থায় পরীরা
মনোহরকে পিতৃরাজ্যে রেখে আসে। মনোহর কামপীড়ায় অধীর হয়ে যোগবেশে
মধুমালতীর সন্ধানে নিরুদ্দেশযাত্রা করে। সমুদ্রপথে জাহাজডুবিতে মনোহর
নিঃস্ব ও নিঃসঙ্গ অবস্থায় অজানা দ্বীপে উপস্থিত হয়। সেখানে দৈত্য কর্তৃক
অপহৃতা রাজকন্যা পায়মার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। পায়মা জটবহরের রাজা
ছত্রসেনের কন্যা। মধুমালতী তার সখী। দুজনে পরামর্শ করে কৌশলে দৈত্যকে বধ
করে জটবহর রাজ্যে উপস্থিত হয়। অতঃপর পায়মার দৌত্যে মনোহর-মধুমালতীর মিলন
হয়। কিন্তু মধুমালতীর মাতা রূপমঞ্জরী কুলকলঙ্কের ভয়ে কন্যাকে
রাজ-অন্তঃপুরে রেখে মনোহরকে কঙ্গিরায় প্রেরণ করেন। তিনি ঘুমন্ত অবস্থায়
তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ আনেন। রূপমঞ্জরী প্রেমাতুরা মধুমালতীকে শুকপাখিতে
রূপান্তরিত করেন। পাখিরূপিনী মধুমালতী উড়ে গিয়ে মাণিক্যরসের রাজা
তারাচাঁদের হাতে ধরা পড়ে। তারাচাঁদ দয়াপরবশ হয়ে তাকে পিতৃরাজ্যে নিয়ে
যায়; মা তাকে পুনরায় মানবীরূপ দান করেন। অতঃপর পায়মার সাহায্যে
মনোহর-মধুমালতীর বিবাহ ও মিলন হয়। তারাচাঁদের সাথে পায়মারও বিবাহ হয়।
মনোহর ও মধুমালতী কঙ্গিরায় উপস্থিত হলে পিতামাতা তাদের বরণ করে নেয়।
রাজ্যে আনন্দের জোয়ার ওঠে।
শাহ বারিদ খান / সাবিরিদ খান
শাহ বারিদ খান চট্টগ্রামের একজন কবি। তিনি 'বিদ্যাসুন্দর',
'হানিফা কয়রাপরী' ও 'রসূল বিজয়' কাব্য রচনা করেন। তিনখানি কাব্যই খণ্ডিত
আকারে আবিষ্কৃত হওয়ায় কবির জন্মস্থান, জন্মকাল ও পৃষ্ঠপোষক অজ্ঞাত রয়ে
গেছে।
শাহ বারিদ খানের 'শাহ' উপাধি থেকে মনে হয় তিনি সুফী তরিকার সাধক
ছিলেন। 'আশিক ও মাসুক'র তত্ত্ব আরোপ করে তিনি 'বিদ্যাসুন্দর' কাব্য রচনা
করলেও আখ্যানভাবে সেরূপ তত্ত্বের ব্যঞ্জনা পাওয়া যায় না।
বিদ্যাসুন্দর-প্রেমকাহিনীর আদি উৎস কাশ্মীরের কবি বিহনের রচিত
সংস্কৃত চৌরপঞ্চাশিকা তথা পঞ্চাশটি শ্লোকে বিধৃত আদিরসের প্রেমকবিতা বিহন
এগার শতকে আবির্ভূত হন। মূল সংস্কৃত 'চৌরপঞ্চাশিকা' মানব প্রেমাশ্রিত রচনা।
শ্রীধর ও শাহ বারিদ খানের 'বিদ্যাসুন্দর' কাব্য রূপক নয়, রূপজ
প্রেমকাব্য। হানিফা ও কয়রাপরী আধা-জঙ্গনামা ও আধা-রোমান্সধর্মী উপাখ্যান।
হানিফা-কয়রাপরীর কাহিনী
মদিনা থেকে হানিফা সঙ্গীসহ মৃগয়ায় গেলেন। মৃগয়াস্থলে
সহীরামের রাজকন্যা জয়গুণের সাথে হানিফার সাক্ষাৎ ও সংগ্রাম হয়। জয়গুন
দ্বৈরথে পরাভূত হয়ে হানিফাকে পতিরূপে বরণ করেন। দিগ্বিজয়ে বের হয়ে
হানিফা পথে এক দুর্বৃত্তের কবলে পড়ে বিপদগ্রস্ত হন; হানিফা কৌশলে
দুর্বৃত্ত রাজাকে হত্যা করেন এবং মন্ত্রীকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত ও সিংহাসনে
প্রতিষ্ঠিত করেন। জনুদ শাহের উদ্যানে হানিফা-জয়গুণের পুনর্মিলন হয়।
তাঁরা জদ শাহকে পরাভূত করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। জনুদ শাহের উদ্যানে
কয়রাপরী প্রথমে হানিফাকে নিদ্রিতাবস্থায় দেখা দেয়।
হানিফা এম্রান দেশে গিয়ে উপস্থিত হয়। তিনি এদেশের দুই
দুর্ধর্ষ ভগ্নীকে যুদ্ধে পরাভূত করে তাদের ভ্রাতা এম্রানকে রাজ্যদান করেন।
এম্রানকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত এবং তাঁর সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে হানিফা
সহীরামের রাজ্যে প্রবেশ করেন। সহীরামের চক্রান্তে হানিফা এক কূপে পড়ে
বন্দী হন; কিন্তু জয়গুণ অচিরেই তাঁকে উদ্ধার করে এম্রান শাহের রাজ্যে
আশ্রয় গ্রহণ করেন। এখানে এক সুরম্য ভবনে বিশ্রামকালে কয়রাপরী হানিফাকে
নিয়ে স্বীয় পিতৃরাজ্য রোকাম শহরে চলে যায়। হযরত আলীর চেষ্টায় এবং
রসূলের ‘কুদরতি সংবাদে' নিরুদ্দিষ্ট হানিফার ঠিকানা জানা যায়। জয়গুণ
মোকাবিলকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীকে উদ্ধার করতে এগিয়ে যান। পথে মিন্নাজ শাহের
সাথে জয়গুণের ও পার্শ্ববর্তী রাজ্যের অধিপতি দুর্মকের সঙ্গে যুদ্ধে
অবতীর্ণ হন। উভয়ের মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়।
কাহিনীটি এখানে খণ্ডিত । একটি বিচ্ছিন্ন পত্রে আছে,
জয়গুণ শাহপরীর কাছে আত্মপরিচয় দেন। শাহপরী কয়রাপরীর পিতা। কয়রাপরী
হানিফাকে হরণ করে বন্দী করে রেখেছে সেকথাও তাঁর কর্ণগোচর করেন। পরের ঘটনা
অনুমিত হয় যে, শাহপরীর চেষ্টায় জয়গুণের সঙ্গে হানিফার পুনর্মিলন হবে এবং
হানিফা সস্ত্রীক মদীনায় প্রত্যাবর্তন করবেন।
আবদুল হাকিম
কবি আবদুল হাকিমের প্রণয়োপাখ্যানগুলো হলো - ‘ইউসুফ জোলেখা’ -
এবং ‘লালমতি- চ-সয়ফুলমুলুক'। কবি আবদুল হাকিম নিজেকে বাঙালি বলতে গর্ববোধ
করতেন । মধ্যযুগে একদল মুসলমান বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করতো। কবি এদের নিন্দা
করে রচনা করেছিলেন বিখ্যাত পঙ্ক্তি -
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী ।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি॥
তাঁর আরেকটি বিখ্যাত পঙ্ক্তি হলো - ‘দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায় নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।’
কবি আবদুল হাকিমের তত্ত্বমূলক গ্রন্থ হলো - নূরনামা, নসিয়তনামা, সবারমূখতা, চারি মোকামভেদ, দোরবে মজলিশ ইত্যাদি।
সৈয়দ সুলতান
ষোড়শ শতকের যুদ্ধকাব্য রচয়িতাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা খ্যাতিমান কবি
সৈয়দ সুলতান । তিনি কেবল কবিই ছিলেন না, ছিলেন সুফি-সাধক ও শাস্ত্রবিদ
তাঁর সমসাময়িক কালের কবিদের রচনা থেকে জানা যায় যে, তিনি পীর ছিলেন। তাঁর
জীবনকাল আনুমানিক ১৫৫০-১৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দ। কবির জন্মভূমি চট্টগ্রাম জেলার
চক্রশালা গ্রাম। তিনি অনেকগুলো কাব্য রচনা করেন। তাঁর কাব্যগুলো হলো
‘নবী-বংশ’, ‘শবে মিরাজ’ ‘ওফাতে রসূল’, ‘নবীবংশ', ‘জয়কুম রাজার লড়াই’,
‘ইবলিশ নামা’, ‘জ্ঞান চৌতিশা’, ‘জ্ঞান প্রদীপ' ।
এছাড়া তিনি লিখেছেন মারফতি গান এবং পদাবলি। 'নবীবংশ' গ্রন্থের শেষাংশ
হলো ‘শবে মিরাজ’।
তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ হলো ‘নবী বংশ'। এতে তিনি কেবল ইসলাম
ধর্মীয় নবীদের কাহিনী লিখেননি, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ও হরির কথাও লিখেছেন।
তিনি চার বেদকে ঈশ্বরপ্রেরিত শাস্ত্রগ্রন্থ হিসেবে গণ্য করেছিলেন । এ
কাব্যের উৎস হিসাবে আরবি-ফারসি সাহিত্যের নামোল্লেখ করা যায় । শবে-বরাত ও
ইবলিশনামা নবী-বংশ কাব্যের অংশবিশেষ । তাঁর ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে শুভ
আল্লাহতায়ালা ও
তাঁর রসুলের সঙ্গে অশুভ ইবলিশ ও তার সহচরদের দ্বন্দ্ব এবং এই
দ্বন্দ্বের ফলে শুভর জয়লাভের বিষয় বর্ণিত হয়েছে।
গুলে বকাওলী
গুলে বকাওলীর প্রথম রচয়িতা ইজ্জতুল্লাহ নামক জনৈক বাঙালি লেখক।
তিনি ১৭২২ সালে ফারসি ভাষায় গ্রন্থটি রচনা করেন। এ গ্রন্থটি হিন্দি থেকে
ভাষান্তরিত। গদ্যে রচিত এ গ্রন্থের কাহিনি কাব্যে রূপ দিয়ে গুলে বকাওলী
বাংলা ভাষায় রচনা করেন নওয়াজীশ খান ।
চট্টগ্রামের বাণী গ্রামের জমিদার বংশের আদি পুরুষ বৈদ্যনাথ রায়ের
অনুপ্রেরণায় নওয়াজীশ খান রচনা করেন গুলে বকাওলী। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর
মতে, গ্রন্থটি অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রচিত ।