উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর বাংলার মুসলমান সমাজে নারীদের অবস্থা
উনিশ শতকের বাংলার হিন্দু ও মুসলিম — উভয় সমাজেই — পর্দা ও অবরোধ প্রথা সমাজে নারীমুক্তির ও উন্নতির পথে অন্তরায় — এই ধরণের চেতনা থেকে এগুলির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ জানিয়ে রাখা প্রয়োজন যে, পর্দা প্রথা ও অববোধ প্রথা কিন্তু একশ্রেণীর নয়। দুটির মধ্যে পার্থক্য হল যে, যথাবিধি পর্দা বা বোরখা পরিধান করে নারীরা যেখানে বাইরের সমাজে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন, অবরোধ প্রথার নিয়ম সেখানে অত্যন্ত কঠোর। অবরোধ প্রথানুসারে নারী কোন অবস্থাতেই পুরুষ সমাজের মধ্যে অথবা বহির্জগতে আসতে পারেন না; একজন অসূর্যস্পশ্যা নারীর মতই তাঁকে আমৃত্যু গৃহে বন্দিনী থাকতে হয়।
যাই হোক, ঊনিশ শতকের বাংলার মুসলিম সমাজে পর্দা ও অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটার অগ্রদূতী ছিলেন — রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তিনি সেযুগের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা না পেলেও, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত নিজের ভাইয়ের কাছ থেকে প্রথমে আধুনিক শিক্ষার স্বাদ পেয়েছিলেন। এরপরে তিনি তাঁর নিজের চেষ্টায় জ্ঞানার্জন করেছিলেন। তারপরে ভাগলপুর নিবাসী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাখাওয়াত হোসেনের সহধর্মিনী হিসাবে স্বামীর সক্রিয় সহযোগিতায় তাঁর জ্ঞানচর্চা আরও প্রসারিত হয়েছিল। আলোচ্য সময়ে কোন বিদ্যালয়ে শিক্ষা পাওয়া তো দূরের কথা, গৃহশিক্ষকের কাছ থেকে বাংলা ভাষা শিক্ষা করবার জন্য তাঁর জ্যেষ্ঠ ভগিনী করিমুন্নেসা চৌধুরানী তৎকালীন মুসলিম সমাজের পক্ষ থেকে কি ধরণের বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন সেটা নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি নারীদের বিবাহিত জীবনে অবরোধ প্রথার নিষ্ঠুর রূপটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সেযুগের পুরুষ-শাসিত সমাজে নারীরা বাড়ির অন্তঃপুরে ধর্মের নামে প্রায় বন্দীদশায় বাস করতেন। বেগম রোকেয়া সেটাকে তৎকালীন সমাজের নারীর চাপিয়ে দেওয়া অবিচার বলেছিলেন। আলোচ্য সময়ের নারীরা বাইরের মুক্ত আলো-বাতাসে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারতেন না বলে তাঁরা শারীরিক দিক থেকে যেমন ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারিণী হতেন, তেমনি আবার মানসিক দিক থেকেও পরিণতি লাভ করতে পারতেন না। তাঁরা তখন পরমুখাপেক্ষী ও পরনির্ভরশীল হয়েই নিজেদের জীবনপাত করতেন। বেগম রোকেয়া দেখতে পেয়েছিলেন যে, স্বামীর অর্ধাঙ্গিনী হিসাবে সমাজে নারীরও কিছু করণীয় রয়েছে। তিনি জানিয়েছিলেন যে, ন্যায্য অধিকার পেলে নারীরাও তাঁদের নিজেদের চিন্তাশক্তি ও কর্মদক্ষতার দ্বারা সমাজের উন্নতিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। সেই ব্যাপারে তৎকালীন সমাজপতিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য তিনি সেযুগের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অনেক মননশীল প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘মতিচুর’ প্রবন্ধ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে একথার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। বেগম রোকেয়ার মত ছিল যে, পর্দা ও অবরোধ প্রথা দূর করে নারীমুক্তি আনতে হলে প্রথমে নারীকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করবার প্রয়োজন রয়েছে; শিক্ষার মাধ্যমে নারীর ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটা সম্ভব। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষা এবং সেই সঙ্গে বাইরে কাজ করবার সুযোগ পেলে নারী অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করতে পারবে। সেই কারণেই তিনি তাঁর ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসে নারীর সেই অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে নারীমুক্তির অন্যতম উপায় বলে নির্দেশ করেছিলেন। তাঁরই উদ্যোগ ও উৎসাহের ফলে বঙ্গদেশে নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য ১৯১১ সালে কলকাতায় ‘সাখাওয়াত হোসেন মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু নারীশিক্ষা ও মুক্তির কথা বলতে গিয়ে, তৎকালীন হিন্দু ও মুসলিম — উভয় সমাজের চোখেই তিনি নিন্দার ভাগী হয়েছিলেন। সেযুগে তাঁর বিভিন্ন লেখা নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল।
বেগম রোকেয়া ১৩১১ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যার ‘নবনূর’ পত্রিকায় ‘আমাদের অবনতি’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে তৎকালীন বাঙালী মুসলমান সমাজে নারীর স্থান ‘দাসীতুল্য’ বলে অভিযোগ ও অনুশোচনা করেছিলেন। সেই প্রবন্ধে তিনি নারী সমাজকে জেগে ওঠবার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন —
“প্রথমে জাগিয়ে উঠা সহজ নহে, সমাজ গোলমাল বাধাইবে, ... ভারতবাসী মুসলমান আমাদের জন্য ‘কৎল’-এর বিধান দিবেন, ... কিন্তু সমাজের কল্যাণ নিমিত্ত জাগিতে হইবেই।”
এছাড়া তিনি নবনূর পত্রিকায় ‘বোরখা’, ‘অর্ধাঙ্গী’ ইত্যাদি শিরোনামে বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখেছিলেন — যেগুলির মধ্যে তাঁর প্রগতিশীল চিন্তার ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। ‘বোরখা’ শিরোনামের প্রবন্ধে তিনি মুসলিম সমাজে প্রচলিত কৃত্রিম পর্দার নবীকরণ দাবী করে বলেছিলেন —
“আমরা অন্যায় পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব। প্রয়োজন হইলে অবগুন্ঠনসহ মাঠে ময়দানে বেড়াইতে আমাদের আপত্তি নাই।” (নবনূর, বৈশাখ সংখ্যা, ১৩১১ বঙ্গাব্দ, পৃ- ১৯)
বলাই বাহুল্য যে, বেগম রোকেয়ার লেখা নিয়ে তৎকালীন মুসলিম সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ করে ১৩১১ বঙ্গাব্দের অশ্বিন সংখ্যার ‘নবনূর’ পত্রিকায় এস. এ. আল মুসভী ‘অবনতি প্রসঙ্গ’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন —
“নারী কখনও সমস্ত বিষয়ে পুরুষের সমতুল্য হইতে পারে না — তাহা হইলে স্বভাবের বিরুদ্ধাচরণ করা হইবে।”
এরপরে একই বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যার ‘নবনূর’ পত্রিকায় নওশের আলী খান ইউসফজয়ী ‘একেই কি বলে অবনতি’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে মুসলিম সমাজের নারীদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন —
“আপনারা স্বাধীন হউন ভাল কথা, কিন্তু স্বাধীনতার অপব্যবহার না করেন, ইহাই প্রার্থনীয়।”
১৩১১ বঙ্গাব্দের ১৪ই আশ্বিন তারিখের ‘মিহির ও সুধাকর’ পত্রিকায় (পৃ: ৪-৫) জনৈক লেখক বেগম রোকেয়ার উপরোক্ত প্রবন্ধের বিরোধিতা করে মন্তব্য করেছিলেন —
“তিনি উচ্চ শিক্ষার ফলে সনাতন মুসলমান ধর্ম গ্রন্থ সম্বন্ধে যেরূপ ভ্রান্ত মত প্রকাশ করিয়াছেন তৎপ্রতি বিশ্বাস স্থাপন করিলে ধর্মই একেবারে ভিত্তিশূন্য হইয়া পড়ে। তিনি ধর্মগ্রন্থগুলিকে মনুষ্য রচিত বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। ... তিনি যদি তাঁহার মত অভ্রান্ত মনে করেন, তবে জানিলাম তাঁহার দ্বারা এ পোড়া সমাজের বিন্দুমাত্র উপকার সাধিত হইবার আশা নাই। ... আমি বলি, যে শিক্ষায় ধর্মের প্রতি অনাস্থা জন্মে ও তাহার বন্ধন শিথিল করে, তাহার প্রচলন না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।”
গবেষকদের মতে খুব সম্ভবতঃ ‘ইসলাম-প্রচারক’ পত্রিকার মাধ্যমেই ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর বাঙলার মুসলমান সমাজে প্রচলিত অবরোধ-প্রথা নিয়ে প্রথম আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল। ১৯০০ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সংখ্যার ইসলাম-প্রচারক পত্রিকার ৩৩ নং পৃষ্ঠায় মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন শিরাজী — ‘অতীত কাহিনী’ — শিরোনামের একটি কবিতা প্রকাশ করেছিলেন। সেই কবিতার ৩০ নং স্তবকের পাদটীকায় কবি মন্তব্য করেছিলেন —
“ভারতবর্ষে নানা জাতীয় বিধর্মীর বাস এবং স্ত্রীগণ অশিক্ষিতা, পুরুষগণও চরিত্রবিষয়ে মুসলমানোচিত নহে, তদ্ব্যতীত সর্বত্রই পাপদৃশ্য, কুৎসিত বাক্য, অশ্লীল সঙ্গীত, কুলটা লম্পট যুগের সাতিশয় আবির্ভাব। অধিকন্তু পরিচ্ছদ-আদিও মুসলমান সভ্যতানুযায়ী নহে। এজন্য পর্দার একান্ত আবশ্যকতা পরিলক্ষিত হয়।”
কিন্তু উক্ত পত্রিকার সম্পাদক সেবিষয়ে কবির সাথে একমত হতে না পেরে সেই একই সংখ্যার পত্রিকার একই পৃষ্ঠায় — “অবরোধ প্রথা সম্বন্ধে আলোচনার প্রয়োজন” — রয়েছে বলে নিজের মন্তব্য প্রকাশ করেছিলেন।
এরপরে শ্যামাসুন্দরী দেবী তাঁর ‘সাবিত্রী প্রবন্ধাবলী’–তে ‘বাল্যবিবাহ ও অবরোধ প্রথা’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ রচনা করলে ইসলাম-প্রচারক পত্রিকায় সেটার প্রতিবাদ জানিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল। শ্যামাসুন্দরী দেবী তাঁর প্রবন্ধে তৎকালীন মুসলমান সমাজে প্রচলিত অবরোধ প্রথাকে কারাবাসের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তাঁর সেই বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ১৯০৩ সালের মার্চ-এপ্রিল সংখ্যার ইসলাম-প্রচারক পত্রিকার ৮৮ নং পৃষ্ঠায় আলাউদ্দীন আহমদ ‘ইসলাম দর্শন’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন —
“পরদার ব্যবস্থা কেবল এই অভিপ্রায়ে নহে যে, পবিত্রতা ও শুদ্ধচারিতা স্থাপিত হয়, বরং বংশগত মর্যাদা এবং গৃহকার্যের শৃঙ্খলা ইত্যাদি যাহা কেবল স্ত্রীলোকদের হস্তে ন্যস্ত থাকে; তাহা তাঁহাদের গৃহে থাকায়, সাধিত হয়, ইহাও পর্দার অন্যতম উদ্দেশ্য। … এমন সুন্দর ও প্রশংসনীয় অবরোধপ্রথাকে কারাবাসের সহিত তুলনা করা সত্য ও ন্যায়ের মস্তকে পদাঘাত করা, স্ত্রী-স্বাধীনতা ও স্ত্রী শিক্ষা বলিয়া যে চীৎকার করা হইতেছে এবং অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে যে নানা কথা প্রকাশ করা হইতেছে, তাহাকে পাগলের প্রলাপোক্তি ভিন্ন আর কি বলা যাইতে পারে?”
১৯০৩ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘মহামেডান এডুকেশন্যাল কনফারেন্স’–এ খোজা সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতা সুলতান মোহাম্মদ আগা খান তাঁর সভাপতির ভাষণে পর্দাপ্রথাকে মুসলমান সমাজের পক্ষে — ‘অতিশয় অনিষ্টজনক’ — বলে উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর সেই বক্তব্যের প্রতিবাদে মোহাম্মদ করম চাঁদ ১৩১৪ বঙ্গাব্দের ৮ম বর্ষের ১০ম সংখ্যার ইসলাম-প্রচারক পত্রিকায় — ‘হেজাবন্নেসা বা মোসলেম রমণীর পর্দা’ — শিরোনামের একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। পর্দা প্রথার পক্ষ নিয়ে সেই প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন —
“হজরত মোহাম্মদের সময়ে, ইসলামানুমোদিত যেরূপ সরল ও তাঁহার উদার ভাবের অবরোধ প্রথা (হেজাবের) প্রচলন ছিল, বর্তমান যুগে তদপেক্ষা কিঞ্চিৎ কঠিন ধরনের পর্দার যে নিতান্ত আবশ্যক, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কারণ এক্ষণে ধর্ম ও নীতিবিবর্জিত নাস্তিক ভাবের পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার বিস্তার হওয়ায় সমাজবন্ধনও ক্রমান্বয়ে শিথিল হইয়া যাইতেছে।”
মোহাম্মদ করম চাঁদের উপরোক্ত প্রবন্ধের প্রতি নিজের সমর্থন জানিয়ে ইসলাম-প্রচারক পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক রেয়াজুদ্দীন আহমদ ঐ একই সংখ্যার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন —
“ভারতীয় মুসলমানদিগের মধ্যে পর্দার যে অতিরিক্ত বাঁধুনীটুকু আছে, যেটুকু না থাকিলে বর্তমান সময়ে এ বিধর্মী প্লাবিত দেশে, নাস্তিকতা ও স্বেচ্ছাচারিতার আমলে, মুসলমানদিগের ধর্ম ও সুনীতি রক্ষা করা কঠিন ব্যাপার … সকল দেখিয়া শুনিয়া সকল বিষয়ে ভাবিয়া চিন্তিয়া আমরা ভারতীয় মুসলমানদিগের বর্তমান অবরোধ প্রথার সমর্থন করিতেছি।”
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, এস. এ. আল মুসভী, নওশের আলী খান ইউসুফজয়ী, আলাউদ্দীন আহমদ, করম চাঁদ এবং মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ — আলোচ্য সময়ের মুসলিম সমাজে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজবন্ধনকে অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্য পর্দা প্রথা ও অবরোধ প্রথার সপক্ষে নিজেদের মতপ্রকাশ করেছিলেন। সেবিষয়ে তাঁদের দৃষ্টি রক্ষণশীল ছিল। মুসলিম সমাজে স্ত্রী-স্বাধীনতা সম্পর্কে শ্যামাসুন্দরী দেবীর অভিমতকে সেযুগের নব্যশিক্ষিত কাজী ইমদাদুল হকও সমর্থন করতে পারেননি। এই প্রসঙ্গে তিনি ১৩১০ বঙ্গাব্দের ‘নবনূর’ পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘হিন্দু নারীর মুসলমান ঘৃণা’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন —
“স্ত্রী-স্বাধীনতার কথা বলিতে গেলে শুধু রাস্তায় বাহির হইয়া পাউডার বিলোপিত মুখশ্রী এবং আঁটসাঁট অঙ্গরাখা দ্বারা কঠিনরূপে আবদ্ধ দেহযষ্টির ভঙ্গিমা দেখাইয়া বেড়ানই যে স্বাধীনতা কোন সূক্ষ্মদর্শী জ্ঞানী ব্যক্তি একথা মনেও করিবেন না।”
মুসলমান সমাজে অবরোধ প্রথা বিলোপ তথা স্ত্রী-স্বাধীনতা সম্পর্কে বাদ-প্রতিবাদ সম্পূর্ণ বিংশ শতক ধরে চলেছিল বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। অবশেষে বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের কাছাকাছি সময় থেকে ‘মাসিক মোহাম্মদী’ ও ‘সওগাত’ পত্রিকায় পুরুষ লেখকেরা প্রথমবারের জন্য মুসলমান সমাজে পর্দাপ্রথা ও অবরোধ প্রথার বিপক্ষে নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করতে শুরু করেছিলেন। (সাময়িকপত্রে জীবন ও জনমত, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, পৃ- ৯১ ও ৯৩ দ্রষ্টব্যঃ)
ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর বাংলার মুসলমান সমাজে প্রচলিত পর্দা ও অবরোধ প্রথার মত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, বিধবাবিবাহ, তালাকপ্রথা, বাঁদী প্রথা ইত্যাদিও নারীকেন্দ্রিক সমস্যা ছিল। সতীদাহ রোধ বা বিধবাবিবাহ প্রচলন, গৌরীদান প্রথা ও কুলীনপ্রথার সংস্কার বিষয়ে সমকালীন হিন্দু সমাজকে বহু সংগ্রাম করতে হয়েছিল। রামমোহন রায় ও পণ্ডিত বিদ্যাসাগরের মত প্রমুখ নেতারা তাঁদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেগুলির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন, এবং দু’-একটি ক্ষেত্র বাদ দিয়ে বেশিরভাগ বিষয়েই তাঁরা সফলতা পেয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন মুসলমান সমাজে বিধবাবিবাহ ও বাল্যবিবাহ কোন ধর্মগত সংস্কারের সঙ্গে জড়িত ছিল না। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে একজন পুরুষ সর্বাধিক চারটি পর্যন্ত বিবাহ করতে পারেন বলে ইসলামে বিধান দেওয়া হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ১৯০৩ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের ইসলাম-প্রচারক পত্রিকার ২৭৭-৭৮ নং পৃষ্ঠায় জানানো হয়েছিল যে, পবিত্র কোরানে সূরা নেসার ২য় আয়াতে রয়েছে —
“তোমাদের যেরূপ অভিরুচি তদনুসারে দুই, তিন ও চারি নারীর পাণিগ্রহণ করিতে পার; পরন্তু যদি অশঙ্কা কর যে, ন্যায় ব্যবহার করিতে পারিবে না, তবে এক নারীকে বিবাহ করিবে।”
ঐ একই সূরায় আরও বলা হয়েছে —
“সকলের সহিত সমান ব্যবহার কর এবং কথোপকথনকালে সকলের সহিত সম্মানসূচক শব্দ ব্যবহার করা উচিৎ।”
সাধারণভাবে ইসলামের নিয়মানুসারে নারীর ভরণপোষণ ও নিরাপত্তার পূর্ণ নিশ্চয়তা না দিয়ে কোন ব্যক্তিই একাধিক বিবাহ করতে পারেন না। ইসলামে সাবালক-সাবালিকা অর্থাৎ যৌবনপ্রাপ্ত হলে তবেই ছেলে-মেয়েরা বিবাহের যোগ্য পাত্র-পাত্রী বলে বিবেচিত হয়ে থাকেন। বন্ধ্যাত্ব, সৌন্দর্যহীনতা, চরিত্রহীনতা, ভগ্নস্বাস্থ্য, উন্মাদগ্রস্ততা বা অন্য কোন কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য ঘটলে ইসলামিক শাস্ত্রানুসারে যে কোন পক্ষ বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন। মুসলমান সমাজে এটি ‘তালাকপ্রথা’ নামে পরিচিত। বিবাহের এসব নিয়মকানুন সম্বন্ধে ইসলামিক ব্যবহারশাস্ত্রে পরিষ্কার নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সুদূর অতীত থেকেই বাংলা তথা ভারতবর্ষের মুসলমান সমাজে ইসলামিক শাস্ত্র বিরোধী কিছু রীতিনীতি পালিত হয়ে চলেছিল — যেগুলিকে দেশাচার বলা যেতে পারে। আলোচ্য সময়ে ইসলামিক শাস্ত্রে থাকা বহুবিবাহ ও তালাক প্রথার কঠোর নির্দেশগুলিকে যথাযথভাবে পালন না করে যথেচ্ছ স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল। গবেষকদের মতে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার প্রভাব থেকেই বাল্যবিবাহ ও বিধবাবিবাহজনিত সংস্কারগুলি মুসলমান সমাজে প্রবেশ করেছিল। তৎকালীন মুসলমান সমাজের পক্ষে এগুলি একান্তভাবে কৃত্রিম সমস্যা হলেও সেইসব বিধিনিষেধ সেযুগের মুসলমানদের সামাজিক জীবনে বিভেদের কালো ছায়া ফেলেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙলার মুসলমানদের মধ্যে মুনশী মেহেরুল্লা প্রথম বিধবাবিবাহ সম্বন্ধে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন। ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত ‘বিধবাগঞ্জনা ও বিষাদ ভাণ্ডার’ নামক একটি গ্রন্থে তিনি সেযুগের কয়েকজন বিধবা নারীর কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে তাঁদের বৈধব্য জীবনের প্রতি তৎকালীন সমাজের ধিক্কার, লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার চিত্র বর্ণনা করেছিলেন। নিজের গ্রন্থে তিনি সেযুগের হিন্দু ও মুসলমান — উভয় সমাজের কাছেই অভিশপ্ত এই রীতির প্রতি তীব্র কটাক্ষ করেছিলেন। তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে, তৎকালীন মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি জেলার অনেক মুসলমান গৃহে বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। বিধবাবিবাহ না হওয়ার ফলে সেযুগের মুসলমান সমাজে ব্যভিচার বৃদ্ধি পেয়েছিল বলে তিনি তাঁর গ্রন্থে জানিয়েছিলেন। তাঁর পরে ১৮৯৬ সালে মোহাম্মদ কফিলউদ্দীন আহমদ তাঁর ‘তারাবতী-মনোহর’ উপন্যাসেও সেযুগের হিন্দু ও মুসলমান — উভয় সমাজে বিধবাবিবাহের সমস্যার কথা তুলে ধরেছিলেন। তিনি উভয় সমাজেই বিধবাবিবাহ প্রচলনের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এরপরে মুনশী মেহেরুল্লাকে অনুসরণ করে মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ ‘কোহিনূর’ পত্রিকায় ‘মোসলেম সমাজ সংস্কার’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তাতে তিনি তৎকালীন মুসলমান সমাজে বিধবাবিবাহ নিয়ে বিরোধিতা কতটা দৃঢ়ভাবে শিকড় বিস্তার করেছিল, সে বিষয়ে ইঙ্গিত করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ১৮৯১ সালের সেন্সাস রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, সেই সময়ে বাংলার মুসলিম পরিবারগুলিতে ৪ থেকে ২৯ বছর বয়স পর্যন্ত বিধবার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে — ১৭, ২১ ও ৩৯০ জন। (Census Report of India, 1891, Vol. IV; The Lower Province of Bengal, p- 178) এই প্রসঙ্গে রেয়াজুদ্দীন আহমদ তাঁর প্রবন্ধে লিখেছিলেন —
“ইসলাম ধর্মের ব্যবস্থানুসারে ‘বিধবাবিবাহ’ একটি গুরুতর কর্তব্য কার্য। আমাদের প্রেরিত মহাপুরুষ স্বয়ং বিধবাবিবাহ করিয়া স্বীয় শিষ্যমণ্ডলীকে এ বিষয়ে পথ প্রদর্শন করিয়া গিয়াছেন। ... পাঠকদিগের মধ্যে অনেকে শুনিয়া অবাক হইবেন যে, কলিকাতার পশ্চিম প্রান্ত প্রবাহিনী ভাগীরথীর পশ্চিমতট হইতে সুদূর পাঞ্জাব প্রদেশ পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ডের অনেক স্থানেই মুসলমানদিগের মধ্যে বিধবাবিবাহ প্রচলিত নাই। বাংলা দেশের মধ্যে বর্ধমান বিভাগস্থ কয়েকটি জেলাতেই উপরোক্তরূপ শাস্ত্রবিরুদ্ধ ঘৃণিত নিয়ম দৃঢ়রূপে প্রচলিত দেখিতে পাওয়া যায়। দেশাচার এমন একটি জিনিস যে, সহজে ইহার সুদৃঢ় প্রাকার ভগ্ন করা যায় না। এই হিন্দু প্রথাটি পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদিগের মধ্যে এরূপ বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছে যে, অনেকে বিধবাবিবাহ দেওয়া বা বিধবাকে বিবাহ করা নিতান্ত অবজ্ঞাজনক কার্য মনে করেন।” (কোহিনূর, আষাঢ় সংখ্যা, ১৩০৫ বঙ্গাব্দ, পৃ: ২৬-২৭। এখানে উল্লেখ্য যে, হজরত মহম্মদের ১৩ জন স্ত্রীর মধ্যে শুধুমাত্র আয়েষার কুমারী অবস্থায় বিবাহ হয়েছিল, অন্যরা সবাই বিধবা ছিলেন।)
এরপরে তিনি উক্ত প্রবন্ধে আরও জানিয়েছিলেন যে, তৎকালীন পাঞ্জাব প্রদেশের ‘জীবন্ত মুসলমানগণ’ সভার আয়োজন করে সেই প্রথার মূলোৎপাটন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
শেখ জমিরুদ্দীন ১৯০৩ সালের ইসলাম-প্রচারক পত্রিকার জুলাই-আগস্ট সংখ্যার ১৮১ থেকে ১৮৫ নং পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ‘মুসলমান সমাজে স্ত্রী-জাতির প্রতি ভীষণ অত্যাচার’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে তৎকালীন মুসলমান সমাজে বহুবিবাহের কুফল সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেছিলেন —
“সুবিশাল বঙ্গদেশে প্রায় তিন কোটি মুসলমানের বাস। এই তিন কোটি মুসলমানের মধ্যে প্রায় দশ পনের লক্ষ মুসলমানের কেহ দুই, কেহ তিন, কেহ বা চার বিবাহ করিয়া একজনকে বিবি ও অপরকে তাঁহার বাঁদী করিয়া অসহ্য যাতনা দিতেছে। কত সময়ে কত সরলা, অবলা বালা, কুলমহিলা নির্মম, অত্যাচারী পাষণ্ড স্বামীর অসহনীয় যাতনা ও কুলকলঙ্কিনী নরপিশাচিনী সতীনের লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সহ্য করিতে না পারিয়া কেহ হলাহল পান, কেহ গলে রজ্জু, কেহ বা আফিং সেবন, কেহ বা অন্য উপায়ে আত্মহত্যা করিয়া অতি শোচনীয়ভাবে প্রাণ নিসর্জন দিতেছে। ... বর্তমান সময়ে মুসলমানগণ যে বহুবিবাহ করিয়া থাকেন, তাহা কেবল রিপু পূজার জন্য কেবল কামপ্রবৃত্তি পূর্ণ করিবার জন্য। ... বর্তমান বহুবিবাহে রাজনৈতিক উপকার কিছুই নাই। ... দিন দিন ব্যয়াধিক্য বশতঃ দীনহীন কাঙ্গাল ও পথের ভিখারী হইতেছে। তাঁহারা অর্থাভাবে মূর্খ ও অসভ্য হইয়া সমাজের ঘোর পতন সাধন করিতেছে, তাঁহাদের দ্বারা সমাজ ও ধর্ম কলঙ্কিত হইতেছে।”
কাজী ইমদাদুল হক ১৩১২ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ সংখ্যার ‘নবনূর’ পত্রিকার ৩৪২-৪৩ নং পৃষ্ঠায় ‘বহুবিবাহ’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেই প্রবন্ধে তিনি তৎকালীন মুসলমান সমাজে প্রচলিত বহুবিবাহ যে বাঁদীপ্রথায় রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে, সে বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে লিখেছিলেন —
“সাধারণ (মুসলমান) সমাজে যে অদ্যাপি বহুবিবাহ প্রথা বর্তমান রহিয়াছে, তাহার উৎপত্তি শাস্ত্রবিধান নহে। শাস্ত্রবিধান সমূহের বিকৃত অর্থকারী একদল স্বার্থপর পুরুষানুক্রমিক পুরোহিত ধর্মের নামে সমাজে প্রতিপত্তি স্থাপন করিয়া বহুকালাবধি আপন স্বার্থ সিদ্ধ করিয়া আসিতেছেন। ... আমাদের সমাজে যে বাঁদী প্রথার উৎপত্তি হইয়াছে, তাহা একমাত্র তাঁহাদেরই সৃষ্টি, এবং যে বহু বিবাহের অযথা প্রসার বৃদ্ধি পাইয়াছে, ইহাও তাঁহাদের স্বার্থ সমুদ্ভূত। ইউরোপের অনুকরণে এক-বিবাহ প্রথা কঠোর অনুশাসনের দ্বারা আমাদের সমাজে বিধিবদ্ধ না করিলে আমাদের আর উদ্ধারের আশা নাই।”
তালাকপ্রথার অপব্যবহার করে আলোচ্য সময়ের মুসলমান সমাজে নারীর প্রতি যে অবিচার চলছিল, সে সম্পর্কে সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মোহাম্মদ করম চাঁদ ১৩১৪ বঙ্গাব্দের ইসলাম-প্রচারক পত্রিকার ৮ম বর্ষের ১২তম সংখ্যায় প্রকাশিত ‘তালাক বা মোসলেম স্ত্রী বর্জন’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন —
“আধুনিক মুসলমানদিগের মধ্যে স্ত্রী এক প্রকার অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে পরিগণিত হইয়াছে বলিলেও হয়। ... অধিকাংশ স্থলেই ইন্দ্রিয় সুখ সম্ভোগের নিমিত্ত এইরূপ কুরীতি অবলম্বন করিয়া থাকে অর্থাৎ স্বামী স্ত্রীকে তালাক দেয়। এই সকল ঘৃণিত ঘটনা অধিক পরিমাণে নিম্নশ্রেণী বা মধ্যবিত্ত অশিক্ষিত বা অজ্ঞ মুসলমানদিগের মধ্যে ঘটিয়া থাকে। ... কিন্তু এরূপ কুরীতি যে ইসলাম ধর্ম বিরুদ্ধ বা কোরান, হাদিস ও ফেকা শাস্ত্র বহির্ভূত, তাহা উল্লেখ করা বাহুল্য মাত্র।”
আলোচ্য যুগের বাঙলার হিন্দু-মুসলমান সমাজে বাল্যবিবাহের কুফল অধিক পরিমাণে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। সমকালীন হিন্দু-মুসলমান — উভয় সমাজেই সেই রীতির প্রচলন ছিল। ঊনিশ শতকের কলকাতায় হরিমোহন-ফুলমণি নবদম্পতির ক্ষেত্রে তেমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল। তাতে অপরিণত বয়সে বিবাহ ও স্বামী সাথে সহবাসের ফলস্বরূপ ফুলমণির অকালে মৃত্যু ঘটেছিল। সেই ঘটনাটি সমকালীন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এরপরে ১৮৯১ সালের জানুয়ারি মাসে স্যার এন্ড্রু স্কোবল বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ‘এজ অব কনসেন্ট এ্যাকট’ বা ‘সহবাস সম্মতি আইন’টি প্রথমে বিল-আকারে উত্থাপন করেছিলেন, এবং সেই বছরেরই মার্চ সেটিকে আইনে পরিণত করা হয়েছিল। ওই আইনে বলা হয়েছিল যে, ১২ বছর বয়স হওয়ার আগে স্ত্রীর সঙ্গে স্বামী সহবাস করলে ধর্ষণের অভিযোগে দণ্ডিত হবেন। হিন্দু-মুসলমান — উভয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই সেই আইনটি প্রযোজ্য করা হয়েছিল। কলকাতায় সেই আইনের বিরুদ্ধে কম প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও ঢাকায় কিন্তু সেটির বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন হয়েছিল। ঢাকার জগন্নাথ কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ কুঞ্জলাল নাগ সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এবং ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকা সেবিষয়ে তাঁর মত প্রচারের বাহন হয়েছিল। তিনি একাধিক সভার আয়োজন করে সহবাস-সম্মতি আইনের বিপক্ষে বক্তৃতা দিয়ে জনমত সৃষ্টি করবার চেষ্টা করেছিলেন। সেকাজে তিনি ঢাকার মৌলভী-মোল্লাদেরও সমর্থন লাভ করেছিলেন। তাঁদের প্রধান বক্তব্য ছিল যে, উক্ত আইনের ফলে নারীর পর্দানশীলতা ও মান-সম্ভ্রমের হানি ঘটবে; এবং শত্রুভাবাপন্ন মানুষেরা সেই আইনের আশ্রয় নিয়ে অন্যদের অত্যাচার ও অপদস্থ করবার সুযোগ পেয়ে যাবেন। বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশক পর্যন্ত সেই নিয়ে তীব্র বাদবিতণ্ডা চলেছিল। এরপরে ১৯৩০ সালের ১লা এপ্রিল তারিখে ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভা কর্তৃক ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ পাশ করা হয়েছিল। সেই আইনে ছেলেদের ১৮ বছর ও মেয়ের ১৪ বছরের কম বয়সে বিবাহ দিলে সেই বিবাহ আইনত দণ্ডনীয় হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। ইতিহাসে সেটি ‘সারদার সর্দা আইন’ নামে খ্যাত।
১৯০৯ সালে সিরাজগঞ্জের মোহাম্মদ মেহেরুল্লা ‘বাল্যবিবাহের বিষময় ফল’ নামের একখানি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন। সেই গ্রন্থে তিনি বাল্যবিবাহের বিষময় পরিণতির কথা উল্লেখ করে ঐ প্রথার অবসান কামনা করেছিলেন।
মীর মশাররফ হোসেন তাঁর ‘আমার জীবনী’ গ্রন্থে সেযুগের মুসলমান সমাজে প্রচলিত দাসী-বাঁদীর কথা উল্লেখ করে জানিয়েছিলেন যে, বাল্যকালে তিনি তাঁর নিজের পরিবারে কমপক্ষে ত্রিশ-বত্রিশ জন দাসী-বাঁদী দেখতে পেয়েছিলেন; যাঁদের মধ্যে অনেককেই রংপুর থেকে ক্রয় করে আনা হয়েছিল। তাঁর ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ প্রবন্ধেও সেযুগের মুসলমান সমাজে দাসী-বাঁদী ক্রয়-বিক্রয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। মোশাররফ হোসেন জানিয়েছিলেন যে, আলোচ্য কালে অনেক সময়ে বাঁদীরা মুসলিম গৃহস্বামীর উপপত্নীরূপেও ব্যবহৃত হতেন; এবং বাঁদী-পুত্ররা সেই বাড়িতে গোলাম বা গৃহভৃত্যের কাজে নিযুক্ত হতেন করত। (মীর মোশাররফের গদ্য রচনা, পৃ: ১৫৭-৫৮) ১৩১০ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসের ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে পরেশনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সেযুগের মুসলমান সমাজে প্রচলিত থাকা ‘বান্দীপ্রথা’–র নিন্দা করেছিলেন। ১৩১০ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যার ‘নবনূর’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে আফতাবউদ্দীন আহমদ জানিয়েছিলেন যে, বান্দীপ্রথা ইসলামিক শাস্ত্রানুমোদিত কোন রীতি নয়, অতীতে ধনীরা তাঁদের নিজেদের গৃহে যে অসংখ্য দাসদাসী রাখতেন, এটি সেটিরই একটি দীর্ঘকালীন কুফল।
– মো: আব্দুল্লাহ আল মামুন
(শিক্ষক বাতায়ন থেকে নেওয়া)

