নদ ও নদীর পার্থক্য : একটি ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

বাংলা ভাষায় ‘নদ’ এবং ‘নদী’—এই দুটি শব্দ প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হলেও, তাদের মধ্যে সূক্ষ্ম এক পার্থক্য রয়েছে। সাধারণভাবে অনেকেই মনে করেন, যার শাখা আছে সেটি নদী, আর যার শাখা নেই সেটি নদ। কিন্তু এই ধারণা পুরোপুরি ভ্রান্ত ও অবৈজ্ঞানিক। প্রকৃত পার্থক্যটি নিহিত আছে ব্যাকরণ ও শব্দতত্ত্বে, অর্থাৎ ভাষার গঠনবৈশিষ্ট্যে।

নদ নদীর পার্থক্য


🔹 প্রচলিত ভুল ধারণা


বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে অনেকেই বলেন—


▫️ “নদীর শাখা থাকে, কিন্তু নদের শাখা থাকে না।”


▫️এই ধারণাটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে, এমনকি অনেক পাঠ্যপুস্তকেও এমন সংজ্ঞা পাওয়া যায়। উইকিপিডিয়ার মতো অনলাইন উৎসেও বহুদিন এই ভুল ব্যাখ্যা লেখা ছিল—যেখানে বলা হয়েছিল, শাখাবিহীন জলধারাকে নদ এবং শাখাযুক্তকে নদী বলা হয়।


▫️কিন্তু এই ধারণা ভৌগোলিক বা ভাষাগত কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বহন করে না। বাস্তবে দেখা যায়, যেমন—


ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে যমুনা ও শীতলক্ষ্যার মতো শাখা নদীর সৃষ্টি হয়েছে।

তবু আমরা বলি “ব্রহ্মপুত্র নদ” — “নদী” নয়।


আবার গঙ্গা নদীরও অনেক শাখা আছে, এবং একে সঠিকভাবেই “নদী” বলা হয়।


🔺🔺তাহলে প্রশ্ন জাগে — কেন এমন পার্থক্য ? 🔺🔺


🔹 প্রকৃত পার্থক্য : ব্যাকরণগত ভিত্তি


যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপকদের মতে, “নদ” ও “নদী”-র পার্থক্য আসলে শব্দের লিঙ্গ ও ধ্বনিগত গঠনে।


🔸 পুরুষবাচক ও নারীবাচক রূপ


বাংলা, হিন্দি, ফারসি, সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষায় সাধারণত:


পুরুষবাচক শব্দ হয় অ-কারান্ত (শেষে ‘অ’ ধ্বনি),


নারীবাচক শব্দ হয় আ-কারান্ত, ই-কারান্ত, বা ঈ-কারান্ত।


উদাহরণ:


যথাক্রমে পুরুষবাচক নারীবাচক👇🏻


ফুল -ফুলি

কুমার -কুমারী

রজক -রজকী

রহিম- রহিমা

নদ-নদী


এখানেই মূল সূত্র —

যে জলধারার নাম অ-কারান্ত (অর্থাৎ পুরুষবাচক ধ্বনিতে শেষ হয়), তাকে নদ বলা হয়।

আর যে নাম আ, ই বা ঈ-কারান্ত, অর্থাৎ নারীবাচক রূপে শেষ হয়, তাকে নদী বলা হয়।


🔹 উদাহরণসহ বিশ্লেষণ


নাম শেষ ধ্বনি ব্যাকরণিক লিঙ্গ সঠিক রূপ


▫️ব্রহ্মপুত্র অ-কারান্ত পুরুষবাচক ব্রহ্মপুত্র নদ। 


▫️কপোতাক্ষ অ-কারান্ত পুরুষবাচক কপোতাক্ষ নদ। 


▫️নীল অ-কারান্ত পুরুষবাচক নীল নদ


▫️গঙ্গা আ-কারান্ত নারীবাচক গঙ্গা নদী


▫️সুরমা আ-কারান্ত নারীবাচক সুরমা নদী


▫️বুড়িগঙ্গা আ-কারান্ত নারীবাচক বুড়িগঙ্গা নদী


▫️যমুনা আ-কারান্ত নারীবাচক যমুনা নদী


তাই দেখা যায়, ‘নদ’ ও ‘নদী’-এর মধ্যে পার্থক্য প্রকৃতিতে নয়, ভাষার গঠনে।


🔹 ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা


‘নদ’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘নদ’ (Nada) থেকে, যার অর্থ ‘প্রবাহিত জলধারা’।

অন্যদিকে ‘নদী’ এসেছে সংস্কৃত ‘নদী’ (Nadī) থেকে, যা সেই একই শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ রূপ।

অর্থাৎ, নদ ও নদী—দুটিই একই মূল শব্দের দ্বি-লিঙ্গ রূপ।

এই রূপান্তরটি ভাষার প্রাকৃতিক বিবর্তনের অংশ, জলধারার গুণের সঙ্গে নয়।


🔹 ভৌগোলিক বা প্রাকৃতিক কোনো পার্থক্য নেই


ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, যমুনা—সবই জলধারা, প্রবাহিত নদপথ। তাদের শাখা, প্রশাখা, মোহনা ইত্যাদি প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে “নদ” বা “নদী” বলা বা না বলার কোনো সম্পর্ক নেই।

এটি পুরোপুরি ভাষাগত রীতি, যেটি নামের লিঙ্গ ও উচ্চারণের ধরন অনুসারে নির্ধারিত।


🔸পরিশেষে বলা যায় যে, 


বাংলা ভাষায় ‘নদ’ ও ‘নদী’ শব্দের পার্থক্য কোনো ভূগোল বা প্রকৃতিবিদ্যার নয়, এটি একান্তই ব্যাকরণ ও শব্দরীতির বিষয়।

অতএব—


ব্রহ্মপুত্র, কপোতাক্ষ, নীল, আমাজন ইত্যাদি হবে “নদ”,


গঙ্গা, যমুনা, সুরমা, বুড়িগঙ্গা ইত্যাদি হবে “নদী”।


ভাষা শেখার সৌন্দর্য এখানেই—যেখানে প্রতিটি শব্দের পেছনে লুকিয়ে থাকে ইতিহাস, ব্যাকরণ ও সাংস্কৃতিক সূক্ষ্মতা।তাই বলা যায়—

 “নদ ও নদীর পার্থক্য প্রকৃতিতে নয়, ব্যাকরণে।”


© Geography zone- ভূগোল বলয়

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url