মধ্যযুগের জীবনী সাহিত্য ও অনুবাদ সাহিত্য
জীবনী সাহিত্য
শ্রী চৈতন্যদেব এবং তাঁর কতিপয় ভাব শিষ্যের জীবন কাহিনী নিয়ে জীবনী সাহিত্যের সৃষ্টি। শ্রীচৈতন্যদেব কখনও কবিতা লেখেননি, কেবল কবিতা নয় তিনি কোনো সাহিত্য সৃষ্টি করেননি, তবুও তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অধিকার করে আছেন বড় একটা স্থান। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে তাঁর প্রভাব অপরিসীম। মধ্যযুগে চৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) জীবনী অবলম্বনে রচিত কাব্যগুলো বাংলাভাষায় জীবনী সাহিত্য রচনার প্রথম প্রয়াস। চৈতন্যদেব প্রবর্তিত ধর্ম হলো মানবপ্রেম ধর্ম। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি হলো : “জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর'
চৈতন্যদেব ষোল শতকে রাধাকৃষ্ণ পালায় রুক্মিনির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। চৈতন্যদেবের জীবনচরিত পদ হিসেবে প্রথম সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়। চৈতন্যদেবের জীবনীগ্রন্থকে 'কড়চা' বলে। কড়চা শব্দের অর্থ ডায়রি বা দিনলিপি। চৈতন্যের প্রথম জীবনীগ্রন্থ 'মুরারি গুপ্তের কড়চা' । এ কাব্যের প্রকৃত নাম 'শ্রীশ্রীকৃষ্ণচৈতন্য চরিতামৃত'। এটি চৈতন্যজীবনীর অবিতর্কিত লেখা এবং মুরারিগুপ্ত চৈতন্য জীবনী রচনার অবিতর্কিত আদর্শের প্রবর্তনকারী। বাংলাভাষায় শ্রীচৈতন্যের প্রথম জীবনীকাব্য বৃন্দাবন দাসের 'শ্রীচৈতন্যভাগবত'। এছাড়া লোচনদাসের 'চৈতন্যমঙ্গল', জয়ানন্দের 'চৈতন্যমঙ্গল', কৃষ্ণদাস কবিরাজের 'শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত', গোবিন্দ দাসের 'কড়চা', চূড়ামণি দাসের 'গৌরাঙ্গবিজয়' উল্লেখযোগ্য ।
বাংলা ভাষায় রচিত সবচেয়ে তথ্যবহুল জীবনী গ্রন্থ শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত'। এটি কৃষ্ণদাস কবিরাজ কর্তৃক রচিত। চৈতন্যদেবের জীবনী ছাড়া বৈষ্ণব ধর্মের আর যারা প্রধান ব্যক্তি ছিলেন, তাদের জীবনী নিয়েও বেশ কিছু বই লিখিত হয়েছে। অদ্বৈত আচার্য ছিলেন এ ধরনের একজন ব্যক্তি। কবি কৃষ্ণদাস সংস্কৃত ভাষায় তাঁর বাল্যকালের কথা লিখেন যা পরবর্তীতে শ্যামানন্দ বাংলায় অনুবাদ করেন 'অদ্বৈততত্ত্ব' নামে। অদ্বৈতজীবনী নিয়ে ঈশান নাগরের 'অদ্বৈতপ্রকাশ' হরিচরণ দাসের ‘অদ্বৈতমঙ্গল' উল্লেখযোগ্য রচনা। এছাড়া অদ্বৈত আচার্যের স্ত্রী সীতাদেবীকে নিয়ে লেখা হয়েছে 'সীতাচরিত', 'সীতাগুণকদম্ব' ।
শ্রী চৈতন্যদেব
শ্রী চৈতন্যদেব ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ১৮ই ফেব্রুয়ারি শনিবার নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দে পুরীতে মারা যান। চৈতন্যের বাল্য নাম ছিল নিমাই, দেহবর্ণের জন্য নাম হয় গোরা বা গৌরাঙ্গ, তাঁর প্রকৃত নাম ছিল বিশ্বম্ভর, সন্নাস গ্রহণের পর শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য- সংক্ষেপে 'চৈতন্য' নামে পরিচিত হন। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাব অপরিসীম। এদেশে বৈষ্ণব ধর্মের ব্যাপক সম্প্রসারণের মাধ্যমে তিনি বিপর্যন্ত হিন্দু সমাজে যে নবচেতনার সঞ্চার করেছিলেন তার ব্যাপক প্রভাব ধর্মের সীমানা অতিক্রম করে তৎকালীন সমাজে ও সাহিত্যে সম্প্রসারিত হয়ে তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন। শ্রী চৈতন্য তাঁর জীবিতকালেই ভগবানের অবতার বলে গৃহীত হয়েছিলেন।
শ্রী চৈতন্যদেব হলেন ধর্মপ্রচারক। তাঁর নামে বাংলা সাহিত্যের একটি যুগের নামকরণ হয়েছে। চৈতন্যদেব প্রচারিত বৈষ্ণব ধর্ম বাংলা কবিতায় বৈষ্ণব দর্শনের প্রবেশ ঘটায়। এর মাধ্যমে বাংলা কাব্য দেবদেবীস্তুতিমূলক ধারা থেকে বেরিয়ে মানবধর্ম প্রশস্তিতে মেতে ওঠে। শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনকাহিনী অবলম্বনে মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে জীবনী সাহিত্যের সূচনা হয়।
বাংলা জীবনী সাহিত্যের ধারা
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের এক বিরাট অংশে জুড়ে আছে জীবনী সাহিত্য। জীবনী
সাহিত্য ধর্মীয় মহাপুরুষদের জীবনীর পাশাপাশি ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস, দর্শন,
সমাজজীবন ও রূপকথা বিধৃত হয়েছে। জীবনী সাহিত্য ধারায় মহাপুরুষদের জীবনের
অদ্যোপান্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে পাঠকগণ
ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনার প্রয়াস পান।
তাই মধ্যযুগের জীবনী সাহিত্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
মধ্যযুগের সাহিত্য ছিল মূলত ধর্মাশ্রিত। দেবদেবীর কথা, ধর্মকথা প্রচারই এ
সাহিত্যের মূল লক্ষ্য। অনুবাদ সাহিত্যের মধ্যে কিছুটা মানবিকতা থাকলেও তা
ধর্মের মোড়কে আবৃত। সুতরাং সে অর্থে মধ্যযুগে মৌলিক সাহিত্য রচিত হয়নি।
কেবল সমগ্র মধ্যযুগে শ্রীচৈতন্যদেবের জীবন কে অবলম্বন করে রচিত জীবনী
সাহিত্য একমাত্র মৌলিক সাহিত্য। তবে আধুনিক যুগে জীবনী সাহিত্য বলতে আমরা
যেমন ব্যক্তিত্ববান মানুষের ভালো-মন্দ, দোষ-গুণ, ভুল-ভ্রান্তি, উত্থান-পতন
প্রভৃতি বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রত্যাশা করি, মধ্যযুগের জীবনী সাহিত্যে তা
প্রত্যাশা করা হবে নিরর্থক। তবে মধ্যযুগের প্রথানির্ভর সাহিত্যের মধ্যে
মর্তের মানুষকে অবলম্বন করে জীবনী সাহিত্যের মতো একটি সাহিত্যের শাখা গড়ে
উঠেছে এখানেই এ সাহিত্যের নতুনত্ব ও গুরুত্ব।
বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগের গতানুগতিক ধারায় জীবনী সাহিত্য এক বিশিষ্ট
স্থান অধিকার করে আছে। এই জীবনী সাহিত্য শ্রীচৈতন্য দেব ও তার কতিপয়
শিষ্যের জীবন কাহিনী নিয়ে এ জীবনী সাহিত্যের সৃষ্টি। তবে তার মধ্যে চৈতন্য
জীবনীই প্রধান। চৈতন্যদেব যে প্রেমধর্মের প্রতিষ্ঠা করে গেছেন-তাতে মানুষে
মানুষে উঁচু-নিচু, হিন্দু-মুসলমান জাত বিভেদ ভুলে সবাই প্রেমমন্ত্রে
উদ্দীপ্ত হয়েছে। ফলে তার শিষ্যগণ তার প্রেম ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে তার
জীবনী নিয়ে আলোচনা করতেন, তা থেকেই এ জীবনী সাহিত্যের সূত্রপাত।
মধ্যযুগের সাহিত্য যেহেতু ধর্মাশ্রয়ী সে অর্থে চৈতন্য জীবনী সাহিত্য এর
প্রভাব মুক্ত নয়। কারণ চৈতন্যকে অনেকেই কৃষ্ণের অবতার হিসেবে বিবেচনা
করছিলেন। তাই তার জীবনী কাব্য ভক্তিকাব্য হয়ে পড়েছে। চৈতন্যের ভক্তরা তাকে
নবরূপী নারায়ণ হিসেবে বিবেচনা করতেন। তাই তার জীবনচরিতে ভক্তি মিশ্রিত হয়ে
বস্তুনিষ্ঠতা হারিয়ে, জীবনী গ্রন্থ হয়েছে দেব-অবতারের মঙ্গলপাঁচালী। তবে
তারা সে যুগের দেশ কাল উপেক্ষা করতে পারেনি। ফলে সে সময়ের সামাজিক, ভৌগোলিক
অবস্থা এ সাহিত্য ফুটে উঠেছে। চৈতন্য জীবনকারদের উদ্দেশ্য ছিল গৌড় সমাজে
গৌরব প্রতিষ্ঠা করা। ফলে কাহিনীতে অলৌকিকতা এসেছে। তবে জীবনী সাহিত্যের
বিশেষত্ব হচ্ছে, তারা সর্বপ্রথম মর্ত্যরে মানুষকে অবলম্বন করে সাহিত্য রচনা
করেছেন। বাস্তব মানুষ সাহিত্যের উপজীব্য হয়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা
করেছে। জীবনে সাহিত্য দুই ভাগে বিভক্ত- সংস্কৃত জীবনী ও বাংলা জীবনী।
চৈতন্যের প্রথম জীবনী রচনা হয় সংস্কৃত ভাষায়। নরহরি সরকার, রঘুনাথ দাস প্রমুখ কবিগণ চৈতন্যবিষয়ক পদ রচনা করেছেন।
চৈতন্যের প্রথম জীবনী লেখক মুরারী গুপ্ত। তিনি চৈতন্য দেবের সমসাময়িক ছিলেন
বিধায় অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। তার কাব্যের নাম শ্রীশ্রী
কৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃত।
কবি কর্ণপুর উপাধিধারী পরমানন্দ দাস সংস্কৃতে দুই খানি গ্রন্থ রচনা করেন-শ্রীচৈতন্যচন্দ্রোদয় নাটক ও শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত মহাকাব্য।
চৈতন্য দেবের বাংলা জীবনীগুলো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
বাঙালির জীবন, সমাজ ও সাধনা সম্পর্কিত অনেক মৌলিক ঐতিহাসিক তথ্য এসব
গ্রন্থে বিধৃত হয়েছে।
বাংলায় প্রথম চৈতন্য জীবনী লেখক বৃন্দাবন দাস। তিনি তার গুরু নিত্যানন্দের
কাছ থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে কাব্যটি লিখেছেন। তার কাব্যের নাম
শ্রীচৈতন্য ভগবত।
চৈতন্যদেবের জীবনকারদের মধ্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজের কাব্য নানাদিক থেকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে। তার কাব্যের নাম শ্রীচৈতন্যচারিতামৃত।
আরও অনেক কবি চৈতন্যদেবের জীবন অবলম্বনে জীবনী সাহিত্য রচনা করেছেন।
মধ্যযযোগের জীবনী সাহিত্যের ইতিবাচক প্রভাব যেমন সমাজজীবনে পড়েছিল তেমনি
সাহিত্যাঙ্গনও সমৃদ্ধ হয়েছিল। মধ্যযুগের কবিরাই সর্বপ্রথম জীবনী সাহিত্যের
সূত্রপাত করেন। বাস্তব মানুষ কে অবলম্বন করে তারাই প্রথম জীবনী লেখেন। তার
থেকে জীবনী সাহিত্যের সূত্রপাত। যার ফলে আধুনিক যুগের সাহিত্যকগণ জীবনী
সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন এবং মহৎ মানুষের জীবনী রচনা করে সাহিত্যঙ্গনকে
সমৃদ্ধ করছেন সেই সঙ্গে পাঠকগণ এ জীবনীগুলো পড়ে নিজের জীবনকে সুন্দরভাবে
গড়ে তোলার প্রয়াস পাচ্ছে।
অনুবাদ সাহিত্য
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিস্তৃত অঙ্গন জুড়ে অনুবাদ সাহিত্যের চর্চা হয়েছিল এবং পরিণামে এ সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধিসাধনে অনুবাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অপরিসীম।সকল সাহিত্যের পরিপুষ্টিসাধনে অনুবাদমূলক সাহিত্যকর্মের বিশিষ্ট ভূমিকা আছে।বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এর ব্যতীক্রম পরিলক্ষিত হয় না।"সমৃদ্ধতর নানা ভাষা থেকে বিচিত্র নতুন ভাব ও তথ্য সঞ্চয় করে নিজ নিজ ভাষার বহন ও সহন ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলাই অনুবাদ সাহিত্যের প্রাথমিক প্রবণতা।"ভাষার মান বাড়ানোর জন্য ভাষার ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হয়,আর তাতে সহায়তা করে অনুবাদকর্ম।উন্নত সাহিত্য থেকে ঋণ গ্রহণ করা কখনো অযৌক্তিক বিবেচিত হয়নি।উন্নত ও সমৃদ্ধ ভাষা-সাহিত্যের সান্নিধ্যে এলে বিভিন্ন বিষয়ের প্রতিশব্দ তৈরি করা সম্ভব হয়,অন্য ভাষা থেকে প্রয়োজনীয় শব্দও গ্রহণ করা যায়।অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বক্তব্য আয়ত্তে আসে।ভাষা ও সাহিত্যের যথার্থ সমৃদ্ধির লক্ষ্যে শ্রেষ্ঠ ও সম্পদশালী ভাষায় উৎকর্ষপূর্ণ সাহিত্যসৃষ্টির অনুবাদ একটি আবশ্যিক উপাদান।
জ্ঞানবিজ্ঞানের বিষয়ের বেলায় শুদ্ধ অনুবাদ অভিপ্রেত। কিন্তু সাহিত্যের অনুবাদ শিল্পসম্মত হওয়া আবশ্যিক বলেই তা আক্ষরিক হলে চলে না।ভিন্ন ভাষার শব্দ সম্পদের পরিমাণ, প্রকাশক্ষমতা ও বাগভঙ্গি অনুযায়ী ভিন্ন ভাষায় ব্যক্ত কথায় সংকোচন, প্রসারণ, বর্জন ও সংযোজন আবশ্যিক হয়।মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে যে অনুবাদের ধারাটি সমৃদ্ধি লাভ করে তাতে সৃজনশীল লেখকের প্রতিভা কাজ করেছিল। সে কারণে মধ্যযুগের এই অনুবাদকর্ম সাহিত্য হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে।
বুলিকে লেখ্য ভাষার তথা সাহিত্যের ভাষায় উন্নীত করার সহজ উপায় হচ্ছে অনুবাদ।অন্যভাষা থেকে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি জ্ঞান-মননের বিভিন্ন বিসয় অনুবাদ করতে হলে সে বিষয়ক ভাব-চিন্তা-বস্তুর প্রতিশব্দ তৈরী করা অনেক সময় সহজ হয়,তৈরী সম্ভব না হলে মূল ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করতে হয়।এভাবেই সভ্য জাতির ভাষা-সাহিত্য মাত্রই গ্রহণে-সৃজনে ঋদ্ধ হয়েছে।এ ঋণে লজ্জা নেই। যে জ্ঞান বা অনুভব আমাদের দেশে পাঁচশ বছরেও লভ্য হত না,তা আমরা অনুবাদের মাধ্যমে এখনই পেতে পারি।যেমনঃ বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থগুলো,শ্রেষ্ঠ দার্শনিক চিন্তাগুলো,বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলো,সমাজতত্ত্বগুলো-মানবচিন্তার শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলো এভাবে আয়ত্তে আসে।
চৌদ্দ পনেরো শতকে আমাদের লেখ্য সাহিত্যও তেমনি সংস্কৃত-অবহটঠ থেকে ভাব-ভাষা-ছন্দ গ্রহণ করেছে,পুরাণাদি থেকে নিয়েছে বর্ণিত বিষয় ও বর্ণনাভঙ্গি এবং রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত-প্রণয়োপাখ্যান-ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতি সংস্কৃত-ফারসী-আরবী-হিন্দি থেকে অনূদিত হয়েছে আমাদের ভাষায়।এভাবেই আমাদের লিখিত বা শিষ্ট বাংলা ভাষাসাহিত্যের বুনিয়াদ নির্মিত হয়েছিল।
আদর্শ অনুবাদকের একটা বিশেষ যোগ্যতা অপরিহার্য। ভাষান্তর করতে হলে উভয় ভাষার গতিপ্রকৃতি, বাকভঙ্গি ও বাকবিধির বিষয়ে অনুবাদকের বিশেষ ব্যুৎপত্তির দরকার। তাহলেই ভাষান্তর নিখুঁত ও শিল্পগুণান্বিত হয়। তাই ভাষাবিদ কবি ছাড়া অন্য কেউ কাব্যের সুষ্ঠু অনুবাদে সমর্থ হয় না।মধ্যযুগে অ-কবিও অনুবাদ কর্মে উৎসাহী ছিলেন। তাই অনুবাদে নানা ত্রুটি দেখা যায়।এছাড়া এঁরা নিজেদের সামর্থ্য রুচিবুদ্ধি ও প্রয়োজন অনুসারে মূল পাঠের গ্রহণ-বর্জন ও সংক্ষেপ করেছেন।এজন্য মধ্যযুগের বাংলা ভাষায় কোন তথাকথিত অনুবাদই নির্ভরযোগ্য নয়।সবগুলোই কিছু কায়িক,কিছু ছায়িক,কিছু ভাবিক অনুবাদ এবং কিছু স্বাধীন রচনা।কাব্য সাহিত্যের অনুবাদ আক্ষরিক হতেই পারে না।
বিশ্বের অপরাপর সাহিত্যের মত বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য অনুবাদ
হয়েছে বাংলা ভাষায়। বাংলা সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট অঙ্গন জুড়ে অনুবাদ
সাহিত্যের চর্চা হয়েছিল এবং এর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি
ঘটেছিল। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে কবিরা অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে
প্রধানত অনুবাদ হয়েছে—
১. সংস্কৃত থেকে (মহাভারত, রামায়ণ, ভাগবত)
২. হিন্দি সাহিত্য থেকে
৩. আরবি-ফারসি সাহিত্য থেকে।
মধ্যযুগের কোনো অনুবাদই হুবহু অনুবাদ নয়। কবিরা মূল কাহিনী ঠিক
রেখে মাঝে মাঝে নিজেদের মনের কথা বসিয়ে দিয়েছেন।
অনুবাদ সাহিত্যে হিন্দু লেখকদের অনুবাদকৃত সাহিত্যের কথা বলা হয়।
মুসলমান সাহিত্যিকদের অনুবাদকৃত সাহিত্যকে রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান বলা
হয়ে থাকে।
রামায়ণ
খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে সংস্কৃত ভাষায় রামায়ণ রচিত হয়। রামচরিত- অবলম্বনে বাল্মীকি সংস্কৃত ভাষায় প্রথম রামায়ণ রচনা করেন। সপ্তকাণ্ডে বিভক্ত এবং চব্বিশ হাজার অনুষ্টুপ শ্লোকে রচিত হয়েছে সুবৃহৎ বাল্মীকি- রামায়ণ। অনেকের অনুমান, সপ্তকাণ্ডের প্রথম কান্ড (বালকাণ্ড) এবং শেষকান্ড (উত্তরকাণ্ড) বাল্মীকির রচনা নয়। কারণ বাকি পাঁচটি কাণ্ডে (অযোধ্যাকাণ্ড, অরণ্যকাণ্ড, কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড, সুন্দরকাণ্ড ও লঙ্কাকাণ্ড) কাহিনী সুসংহত এবং মহাকাব্যোচিত।
বাল্মীকির মূল নাম দস্যু রত্নাকর। 'বল্মীক' মানে হলো উইপোকা। দস্যু রত্নাকর উইপোকার ঢিবির উপর বসে রাম নামের তপস্যা করেন বলে তার নাম হয় বাল্মীকি। রামায়ণের প্রথম অনুবাদক পনের শতকের কবি কৃত্তিবাস ওঝা। তিনি হলেন প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ অনুবাদক।
কৃত্তিবাসের রামায়ণের অন্য নাম 'শ্রীরাম পাঞ্চালী'। এটি প্রথম মুদ্রিত হয় ১৮০২-১৮০৩ সালে শ্রীরামপুরের মিশনারী ছাপাখানায় উইলিয়াম কেরীর উদ্যোগে। কৃত্তিবাসের রামায়ণ-রচনার বহু আগে থেকেই ভারতের পূর্বাঞ্চলে রামায়ণের কাহিনী প্রচারিত হয়ে এসেছে। কৃত্তিবাস পঞ্চদশ শতাব্দীতে রামায়ণের অনুবাদ করলেও ষোড়শ শতাব্দীতে রামায়ণ-অনুবাদে কেউ ব্রতী হননি। সতেরো আঠারো শতকে বেশ কয়েকজন কবি রামায়ণের অনুবাদ রচনা করেন। নিত্যানন্দ আচার্য ও চন্দ্রাবতীকে অনেকে ষোড়শ/সপ্তদশ শতকের কবি বললেও প্রকৃতপক্ষে তাঁরা আঠারো শতকের কবি । সতেরো শতকের (মতান্তরে অষ্টাদশ শতকের) কবি চন্দ্রাবতী রামায়ণ অনুবাদ করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি। চন্দ্রাবতী হলেন মনসামঙ্গলের কবি দ্বিজ বংশীদাসের বিদুষী কন্যা ।
পঞ্চদশ শতাব্দীর অসমিয়া সাহিত্যের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কবি মাধব কন্দলী। মাধব কন্দলী রামায়ণের মধ্যভাগের পাঁচটি কাণ্ড অসমিয়া ভাষায় অনুবাদ করেন। কৃত্তিবাসের ন্যায় মাধব কন্দলীও রাজাজ্ঞায় 'শ্রীরাম- পাঞ্চালী' রচনা করেন। তিনি বরাহ-রাজা মহামাণিক্যের সভাসদ ছিলেন। কিন্তু এ বরাহ রাজা মহামাণিক্য কে ছিলেন তা নির্ণয় করা সম্ভব হয় নি। আসামে নব্য বৈষ্ণব আন্দোলনের উদ্গাতা শঙ্করদেব রামায়ণের উত্তরকান্ড রচনা করে মাধব কন্দলীর রামায়ণে পরিপূর্ণতা এনে দেন ।
মহাভারত
আজ হতে অন্তত আড়াই হাজার বছর পূর্বে সংস্কৃত ভাষায় মহাভারত রচিত হয়। ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মতে এ-কাব্য খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ এবং খ্রিষ্টীয় ২০০ অব্দের মধ্যে রচিত। মহাভারতের কাহিনী রামায়ণের পরবর্তী যুগের হলেও মহাভারত রামায়ণের পরে প্রকাশিত হয়। এটি ১৮ খণ্ডে রচিত এবং এর শ্লোক সংখ্যা ৮৫০০০।
মহাভারতের মূল রচয়িতা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। বেদ এর ব্যাখ্যা করেছিলেন বলে তাঁর অপর নাম বেদব্যাস। রামায়ণের ন্যায় মহাভারতেরও উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলভেদে পৃথক পৃথক আঞ্চলিক রূপ প্রচলিত ছিল । উত্তরাঞ্চলে প্রচলিত মহাভারতের পর্বসংখ্যা আঠার এবং দাক্ষিণাত্যের মহাভারত চব্বিশ পর্বে সমাপ্ত ।
মহাভারত পাঠ্যকাব্য বলেই বিভিন্ন সময়ে এর খণ্ড-পর্ব বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে, পূর্ণাঙ্গ মহাভারতের সংখ্যা তাই কম। একমাত্র কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও কাশীরাম দাস ছাড়া আর কোনো বাঙালি কবি সম্পূর্ণ মহাভারত রচনায় প্রয়াসী হননি ।
ষোড়শ শতকে সুদূর চট্টগ্রামে পরাগল খানের নির্দেশে কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারত রচনা করেন এবং তা পরাগল খানের সভায় পঠিত হয়। তাঁর মহাভারত পরাগলি মহাভারত নামে পরিচিত। কবীন্দ্র পরমেশ্বর অশ্বমেধপর্ব রচনা করেননি, তাঁর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করেন শ্রীকর নন্দী। বেদব্যাস-শিষ্য জৈমিনি-রচিত অশ্বমেধপর্ব এদেশে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। শ্রীকর নন্দী, রামচন্দ্র খান, দ্বিজ রঘুনাথ ছাড়া আরো অনেক কবি জৈমিনি-ভারত অনুবাদ করেন।
কবীন্দ্র পরমেশ্বর আদি অনুবাদক হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। কবীন্দ্র পরমেশ্বরের বিস্তারিত পরিচয় জানা না গেলেও কবির আবির্ভাব-কাল সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য তাঁর কাব্যেই পাওয়া যায়। কাব্যের উপক্রমণিকা থেকে জানা যায় যে, গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহ্ তাঁর সেনাপতি পরাগল খানকে লস্কর বা সেনানী শাসক নিযুক্ত করে চট্টগ্রামে প্রেরণ করেন। পরাগল খান চট্টগ্রামে অনেকদিন বসবাস করেন। হোসেন শাহের (১৪৯৩-১৫১৯) রাজত্বকালে পরাগল খানের অনুরোধক্রমে কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারত অনুবাদ করেন।
কবীন্দ্র পরমেশ্বরের পরাগলি মহাভারত ১৮টি পর্বে এবং ১৭,০০০ শ্লোকে সমাপ্ত। ব্যাস রচিত মূল মহাভারতকে অনুসরণ করলেও পরমেশ্বরের রচনা অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত। কবীন্দ্র পরমেশ্বরের কাব্যটি বর্ণনাধর্মী এবং তাঁর ভাষা স্বচ্ছ, প্রাঞ্জল এবং প্রবহমান।
কবীন্দ্র পরমেশ্বর-অনূদিত মহাভারত যেমন পৃষ্ঠপোষকের নামানুসারে পরাগলি মহাভারত নামে পরিচিত, অনুরূপ শ্রীকর নন্দী-অনূদিত কাব্যও পৃষ্ঠপোষকের নামানুসারে 'ছুটিখানী মহাভারত' নামে চিহ্নিত হয়ে থাকে। ছুটি খানের প্রকৃত নাম নসরত খান, ইনি পরাগল খানের পুত্র।
সতের শতকের কবি কাশীরাম দাস হলেন মহাভারতের বিখ্যাত ও জনপ্রিয়
অনুবাদক ।
অবশ্য তিনি মহাভারত অনুবাদ সম্পন্ন করেননি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর
ভাইয়ের ছেলে এবং আরো কয়েকজন মিলে মহাভারত অনুবাদ সম্পন্ন করেন। কাশীরাম
দাসের 'মহাভারত' এর দুটি বিখ্যাত পক্তি -
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস ভনে শোনে পুণ্যবান।।
ভাগবত
ভাগবত ১২ খণ্ডে রচিত এবং এর শ্লোকসংখ্যা ৬২০০০। হিন্দুধর্মের এই পবিত্র ধর্মগ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেন মালাধর বসু। এজন্য তিনি বাদশাহ রুকনউদ্দিন বরবক শাহের কাছ থেকে ‘গুণরাজ খান' উপাধি লাভ করেন। তাঁর ভাগবতের নাম ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’।
সংস্কৃত ভাষায় রচিত ভাগবত বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নিকট পরম পবিত্র গ্রন্থ। এটি পুরাণ নামক সংস্কৃত সাহিত্যের অন্তর্গত। পুরাণের পাঁচটি লক্ষণ - সর্গ, প্রতিসর্গ, বংশ, মন্বন্তর ও বংশানুচরিত অর্থাৎ সৃষ্টিতত্ত্ব, প্রলয়ের পরবর্তী সৃষ্টিকাহিনী, দেবগণের জন্মবৃত্তান্ত, মনুর অধিকারকাল হিসাবে যুগবিভাগ, রাজাদের বংশকাহিনী ও কার্যকলাপ - কমবেশি ভাগবতে স্থান পেয়েছে। কৃষ্ণের জন্ম, বাল্য, কৈশোর ও যৌবনের ঐশ্বরিক কার্যকলাপ এবং দেহত্যাগের কথা এই গ্রন্থে বর্ণিত । ভগবান বিষ্ণু কৃষ্ণরূপে জন্মগ্রহণ করে যে অদ্ভুত কাজগুলো অনায়াসে সম্পন্ন করেছেন সেগুলো কাব্যরূপে ও পাণ্ডিত্যে সমৃদ্ধ হয়ে ভাগবতে পরিবেশিত হয়েছে।
বেদের মন্ত্রসমূহ বিন্যাস করে যিনি বেদব্যাস আখ্যা পেয়েছেন তিনি অতি প্রাচীন ঋষি এবং হিন্দুসমাজের সর্বাপেক্ষা মাননীয় পণ্ডিত। তাই মহাভারত এবং পুরাণসমূহ ও ভাগবতের রচয়িতারূপে ব্যাসকে নির্দিষ্ট করে গ্রন্থগুলোর পবিত্রতা ও গুরুত্ব বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে এত বিপুল বৃহৎ কলেবরে বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা একজনের পক্ষে রচনা অসম্ভব বলেই যুক্তিসংগত। এজন্য সংস্কৃত ভাগবতের বা ধর্মীয় গ্রন্থ প্রণেতাদের যথার্থ নাম ও কাল চিরদিনের জন্য অজ্ঞাত থেকে গিয়েছে।
মালাধর বসুর পিতার নাম ভগীরথ এবং মাতার নাম ইন্দুমতী। তাঁর জন্ম কায়স্থ বংশে এবং বসতি ছিল বর্ধমান জেলার জামালপুর থানার মেমারী রেলস্টেশনের অনতিদূরে কুলীন গ্রামে। তাঁর একজন পুত্রের উপাধি ছিল ‘সত্যরাজ খান'।
কোরআন শরীফ
কোরআন শরীফের প্রথম অনুবাদক হলেন ভাই গিরিশচন্দ্র সেন । তিনি ১৮৮৬ সালে কোরআন শরীফ অনুবাদ করেন। কোরআন শরীফ অনুবাদ ছাড়াও তিনি 'তাপসমালা' রচনা করেন ‘তাজকেরাতুল আউলিয়া' অবলম্বনে । গিরিশচন্দ্র সেনের উপাধি হলো 'ভাই'। তাঁর বাড়ি ছিল নরসিংদী জেলায়। তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী।
পৃথিবীতে ৪টি জাত মহাকাব্য (Authentic Epic)
রামায়ণ - বাল্মীকি
মহাভারত - কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস
ইলিয়ড - হোমার
ওডিসি - হোমার

