উপসর্গ মনে রাখার টেকনিক । উপসর্গ মনে রাখার কৌশল । উপসর্গ মনে রাখার সহজ টেকনিক

বাংলা ব্যাকরণে কিছু টপিক আছে যা আমরা অনেকেই বুঝি না বা বুঝতে চেষ্টা ও করি না । এর মধ্যে অন্যতম একটি টপিক হচ্ছে উপসর্গ। আমরা এটি ভালভাবে পড়ি না বা পড়লে ও মনে রাখতে পারি না। তাই আজকের পাঠে আমরা উপসর্গ মনে রাখার সহজ কৌশল সহ উপসর্গের বিস্তারিত আলোচনা করব। 

উপসর্গ মনে রাখার সহজ কৌশল


উপসর্গ কী

ইংরেজি ‘Prefix’ শব্দকে বাংলায় ‘উপসর্গ’ বলে।‘উপসর্গ' শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ 'অবাঞ্ছিত বিষয়'। এর ব্যাকরণগত অর্থ হলো উপসৃষ্টি। সুতরাং উপসর্গের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা যায়, যে সকল অব্যয় বা অব্যয়জাত শব্দাংশ ধাতুর পূর্বে বসে নতুন শব্দ গঠন করে সেগুলোকে উপসর্গ বলে। যেমন: পরি+তাপ = পরিতাপ; পরি+হাস = পরিহাস

উপসর্গের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা

বাংলা ভাষায় উপসর্গের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। উপসর্গ নতুন নতুন অর্থবোধক শব্দ গঠন ও শব্দের অর্থের পূর্ণতা সাধন করে। শুধু নতুন শব্দ গঠনই নয়, এরা ধাতু বা শব্দের পূর্বে বসে ধাতু বা শব্দের অর্থের সংকোচন, সম্প্রসারণ ও পরিবর্তন ঘটায়। উপসর্গের নিজস্ব কোন অর্থ নেই, কিন্তু শব্দ সৃষ্টি করে শব্দের বৈচিত্র্য আনয়ন করে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংস্কৃত উপসর্গ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, “ সংস্কৃত ভাষায় কতগুলো টুকরো শব্দ আছে যেগুলোর স্বতন্ত্র কাজ নেই, তারা বাক্যের লাইন বদলিয়ে দেয়। রেলের রাস্তায় যেমন সিগন্যাল, ভিন্নদিকে ভিন্ন রঙের আলোয় তাদের ভিন্ন রকমের সংকেত, সংস্কৃত ব্যাকরণের উপসর্গগুলো শব্দের মাথায় চড়া সেই রকম সিগন্যাল। কোনটাতে আছে নিষেধ। কোনটা দেখায় এগোবার পথ, কোনটা বাইরের পথ, কোনটা নিচের দিকে, কোনটা উপরের দিকে, কোনটা চারদিকে, কোনটা ডাকে ফিরে আসতে। গত' শব্দে আ উপসর্গ জুড়ে দিলে হয় ‘আগত’, সেটা লক্ষ্য করায় কাছের দিক; ‘নির’ জুড়ে দিলে হয় ‘নির্গত’, দেখিয়ে দেয় বাইরের দিক; ‘অনু’ জুড়ে দিলে হয় ‘অনুগত’, দেখিয়ে দেয় পিছনের দিক; তেমনি ‘সংগত’, ‘দুর্গত’, ‘অপগত’, প্রভৃতি শব্দে নানা দিকে তর্জনী চালানো। উপসর্গ থাকে সামনে, প্রত্যয় থাকে পিছনে। তারা আছে একই শব্দের নানা অর্থ বানাবার কাজে।” 

উপসর্গের প্রকারভেদ

বাংলা ভাষায় তিন প্রকার উপসর্গ আছে। যথা :
(১) তৎসম বা সংস্কৃত উপসর্গ
(২) খাঁটি বাংলা উপসর্গ ও
(৩) বিদেশি উপসর্গ 

তৎসম বা সংস্কৃত উপসর্গ

সংস্কৃত ভাষা থেকে গৃহীত উপসর্গগুলোকে তৎসম উপসর্গ বলে। এগুলো তৎসম শব্দের আগে বসে। এ উপসর্গের সংখ্যা মোট বিশটি। যথা : প্র, পরা, অপ, সম, নি, নির, অনু, অব, অধি, অতি, অপি, অভি, পরি, প্রতি, উপ, উৎ, দূর, বি, সু, আ।

তৎসম বা সংস্কৃত উপসর্গ মনে রাখার কৌশল

অবনি বাবু পরি, অভি, অপিঅনুপ্রতি অধিসমঅতিঅপরাধ করেন। প্রথম পরাজিত হয়ে তিনি উপর মহলের নিরঞ্জনকে দূর থেকে উৎকোচ দিয়ে সংস্কৃতের সুবিচার চান।

এখানকার প্রতিটি রঙ্গিন বর্ণই এক একটি তৎসম বা সংস্কৃত উপসর্গ। এখান থেকে ‘সংস্কৃতের’ শব্দটির মাধ্যমে বুঝতে হবে এই ছন্দটি সংস্কৃত উপসর্গ চেনার জন্য।

 

খাঁটি বাংলা উপসর্গ

আর্যদের আগমনের পূর্বে এদেশবাসীর ভাষা থেকে যে সকল উপসর্গ এসেছে তাদেরকে দেশি বা খাঁটি বাংলা উপসর্গ বলে। খাঁটি বাংলা উপসর্গ মোট একুশটি। যথা : অ, অঘা, অজ, অনা, আ, আড়, আন, আর, ইতি, ঊন (ঊনা), কদ, কু, নি, পাতি, বি, ভর, রাম, স, সা, সু, হা।

খাঁটি বাংলা উপসর্গ মনে রাখার কৌশল

প্রিয় অঘারাম,

তোমার বন্ধু আবদুলের ভরসামি, অনু এবং ইতি অনাবৃষ্টির মধ্যে অজ পাড়ার আড়ৎ থেকে ঊনত্রিশটি কদবেল, কুমড়ো, বিনিসুতো এবং বাংলার আনকোরা পাতিহা এনেছি।

এখানকার প্রতিটি রঙ্গিন বর্ণই এক একটি খাঁটি বাংলা উপসর্গ। এখান থেকে ‘বাংলার’ শব্দটির মাধ্যমে বুঝতে হবে এই ছন্দটি খাঁটি বাংলা উপসর্গ চেনার জন্য।

 খেয়াল রাখতে হবে, চারটি উপসর্গ যথা আ,সু,বি,নি । যা বাংলা ও তৎসম উভয় উপসর্গে পাওয়া যায় ।

বিদেশি উপসর্গ

আরবি, ফারসি, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু ইত্যাদি ভাষার বহুশব্দ দীর্ঘকাল ধরে বাংলা ভাষায় প্রচলিত আছে। এসব শব্দের কতগুলো খাঁটি উচ্চারণে, আবার কতগুলো বিকৃত উচ্চারণে বাংলায় ব্যবহৃত হয়। এরই সঙ্গে কিছু বিদেশি উপসর্গও বাংলায় চালু রয়েছে। এগুলো বহুদিন যাবৎ ব্যবহারের ফলে বাংলা ভাষার -সাথে একদম মিশে গেছে।

বিদেশি উপসর্গ মনে রাখার কৌশল

ফারসি উপসর্গ দশটি

বদমেজাজি বেরসিক কলম বর দরদাম না করে বেশি ফি দিয়ে কার যেন কমদামি ফারসি নিমকি কিনে দিয়েছেন। 

এখানকার প্রতিটি রঙ্গিন বর্ণই এক একটি ফারসি উপসর্গ। এখান থেকে ‘ফারসি’ শব্দটির মাধ্যমে বুঝতে হবে এই ছন্দটি ফারসি উপসর্গ চেনার জন্য।

আরবি উপসর্গ চারটি

গরমে আম আর কলা খাস

 ইংরেজি উপসর্গ চারটি

হেড স্যার ফুলপ্যান্ট ও হাফশার্ট পরে ইংরেজি সাবজেক্ট পড়ান।

 

বাংলা শব্দ গঠনে উপসর্গের ভূমিকা

বাংলা শব্দ গঠনে উপসর্গের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। উপসর্গ এক শ্রেণীর অব্যয় হিসেবে হয় এবং ধাতু বা শব্দের পূর্বে বসে নতুন শব্দ গঠন ও শব্দের অর্থের পূর্ণতা সাধন করে। শুধু নতুন শব্দ সৃষ্টিই নয়, শব্দের অর্থের পরিবর্তন, সম্প্রসারণ, সংকোচন ঘটাতে উপসর্গ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উপসর্গ নিজে কোন অর্থ প্রকাশ নাও করতে পারে। কিন্তু অন্য শব্দের আগে বসে এরা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে। এভাবে উপসর্গ বাংলা শব্দ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।

 

আরও সহজভাবে বুঝতে উপসর্গের ভিডিও ক্লাস দেখুন এখানে



উপসর্গের অর্থবাচকতা নেই, কিন্তু অর্থদ্যোতকতা আছে

উপসর্গ নতুন শব্দ গঠনের একটি বিশেষ প্রক্রিয়া। যেসব বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি ধাতু বা শব্দের পূর্বে বসে নতুন শব্দ গঠন করে, সেগুলোকে উপসর্গ বলে। উপসর্গ মূলত কতগুলো অব্যয়সূচক শব্দাংশ।
বাংলা ভাষায়— প্র, পরা, নির, সম, পরি, উপ, অপ, বি প্রভৃতি উপসর্গের নিজস্ব কোন অর্থ নেই; কিন্তু এগুলো নতুন শব্দ সৃষ্টি করে শব্দের বৈচিত্র্য বা পরিবর্তন ঘটাতে পারে। যেমন- উপ’ একটি উপসর্গ, ‘হার’ একটি মৌলিক শব্দ। যার অর্থ অলংকার বিশেষ। ‘হার’ এর পূর্বে 'উপ' উপসর্গ যুক্ত হয়ে ‘উপহার’ শব্দটি গঠিত হয়েছে। যা নতুন অর্থ আলোকিত করে। এভাবে একটি মৌলিক শব্দের পূর্বে বিভিন্ন উপসর্গ ব্যবহৃত হয়ে একাধিক নতুন অর্থের দ্যোতনা সৃষ্টি করতে সক্ষম। যেমন-

উপসর্গ +মূলশব্দ নতুন শব্দার্থ
আ + হার (অলংকার বিশেষ) আহার = খাওয়া
বি + হার (অলংকার বিশেষ) বিহার = ভ্রমণ করা
সম + হার (অলংকার বিশেষ) সংহার = হত্যা
প্র + হার (অলংকার বিশেষ) প্রহার = মারা

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় উপসর্গের নিজস্ব কোন অর্থ নেই কিন্তু অন্য শব্দের অর্থকে বদলে দিতে পারে, এমনকি অর্থের সংকোচন, সম্প্রসারণ করে। তাই, ওপরের বিশ্লেষণ প্রমাণ করে যে, “ উপসর্গের অর্থবাচকতা নেই কিন্তু অর্থদ্যোতকতা আছে।”

 

উপসর্গ ও প্রত্যয়ের পার্থক্য

উপসর্গ ও প্রত্যয়ের কাজ নতুন নতুন শব্দ তৈরি করা। তা সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য বিদ্যমান।
(১) উপসর্গ ধাতু বা শব্দের পূর্বে বসে নতুন শব্দ গঠন করে এবং এগুলো একশ্রেণীর অব্যয় হিসেবে বিবেচিত।অপরদিকে প্রত্যয় ধাতু বা শব্দের শেষে যুক্ত হয় এবং এগুলো এক প্রকার বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি।
(২) উপসর্গ শুধু নতুন শব্দই গঠন করে না, শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটায়, কখনো অর্থের বিশিষ্টতা দান করে।অপরদিকে প্রত্যয় কখনো ধাতুর শেষে কখনো শব্দের শেষে যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করে।

 

বাক্যে উপসর্গের ১০ টি করে ব্যবহার

 

তৎসম : ১০টি

প্র- প্রচণ্ড→ আমার প্রচন্ড রাগ হয়েছে।
পরা - পরাজয়→ পরাজয়ে ডরে না বীর।
অপ – অপরূপ → ধরণী বসন্তে অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়।
সম - সংসার → সংসার সাগরে দুঃখের অন্ত নেই।
নি – নিবৃত্ত→ সে তার মনোবাসনা নিবৃত্ত করতে পারেনি।
অব – অবহেলা→ পাঠে অবহেলা অনুচিত।
অনু – অনুতাপ→ অনুতাপের অনলে দগ্ধ হলো মন।
নির – নির্দোষ→ নির্দোষ লোকটিকে অপমান করা হলো।
দুর – দুর্গম → 'দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার।'
বি - বিজন→ শ্বাপদ-সংকুল বিজন বন ভয়ংকর।

খাঁটি বাংলা : ১০টি

অ- অবেলা→ অবেলায় তুমি কোথায় যাচ্ছ?
অঘা-অঘাচণ্ডী→ তোমার মতো অঘাচন্ডী আর হয় না।
অজ-অজপাড়াগাঁ→ এই অজপাড়াগাঁয় এসে বিপদে পড়েছি।
অনা-অনাছিষ্টি→ তোমার যত অনাছিষ্টি কাণ্ড।
আ-আকাঁড়া→ ‘ভিক্ষার চাল কাঁড়া আর আকাঁড়া।
কু-কুকথা→ কুলোক-কুকথা বলবেই।
নি-নিলাজ→ মেয়েটি বড্ড নিলাজ।
বি-বিপথ→ বিপথে যেও না।
ভর-ভরদুপুর→ ভরদুপুরে চাষী জমিতে লাঙ্গল দেয়।
রাম-রামদা→ রামদা দিয়ে তাকে আঘাত করা হয়েছে। 

বিদেশী উপসর্গ : ১০টি

আম-আমদরবার→ বাদশাহর আমদরবার লোকে লোকারণ্য।
কম – কমজোর → তোমার মতো কমজোর লোক দিয়ে এমন শক্ত কাজ হবে না।
খাস – খাস-চাকর→ আবদুল তাদের বাড়ির খাস-চাকর।
গর- গরমিল → হিসেবে গরমিল হয়ে গেল।
না – নাছোড় → তার মতো নাছোড়বান্দা আর হয় না।
নিম – নিমরাজি → মেয়েটি এ বিয়েতে নিমরাজি।
ফি – ফি-বছর→ ফি বছরই এ দেশে বন্যা হয়।
ব – বকলম → তার মতো বকলম লোক দিয়ে এ কাজ হবে না।
বদ – বদরাগী→ মনির অত্যন্ত বদরাগী।
বর – বরখেলাপ → কখনো কথার বরখেলাপ করো না।

 

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url