বুঝলে ভুজপাতা, না বুঝলে তেজপাতা - প্রবাদ বিশ্লেষণ

বুঝলে ভুজপাতা, না বুঝলে তেজপাতা


বুঝলে ভুজপাতা, না বুঝলে তেজপাতা— বহুল প্রচলিত প্রাচীন বাংলা প্রবাদ। অনেকে লিখে থাকেন— বুঝলে ভোজপাতা, না বুঝলে তেজপাতা। আবার অনেকে বলেন— বুঝলে বুঝপাতা, না বুঝলে তেজপাতা।

তেজপাতা


এর মানে কী? কোনটি শুদ্ধ এবং কোনটি অশুদ্ধ? প্রথমটি ছাড়া বাকি দুটো বাগ্‌ভঙ্গি ভুল।


তেজপাতা কেন?

কারণ, তেজপাতা এমন একটি বস্তু, যা একবার গরম জলে ডোবালে তুচ্ছ আবর্জনা হয়ে যায়। ফেলে দিতে হয় ভাগাড়ে।


ভোজপাতা বা বুঝপাতা নয় কেন?

বুঝপাতা বানানের কোনো শব্দের অস্তিত্ব ও ইতিহাস বাংলায় নেই। এমন কোনো পাতার নামও দেখা যায় না। তাই এটি বুঝপাতা নয়।


তাহলে ভোজপাতা?

না, ভোজপাতাও নয়। ভোজপাতা অর্থ ভোজন করার পাতা। একসময় বাসনকোসন ছিল না। তখন বিভিন্ন গাছের পাতায় ভোজন করা হতো। এমনকি বড়ো বড়ো অনুষ্ঠানাদিতেও পাতায় ভোজন করা হতো। যে পাতায় ভোজন করা হতো তাকে বলা হতো ভোজনপাতা বা ভোজপাতা। প্রবাদের সংশ্লিষ্টতা জ্ঞান-প্রজ্ঞা নিয়ে। তাই এটি ভোজপাতা হতে পারে না। বাকি থাকে— ভুজপাতা।


ভুজপাতা কী?

ভূর্জপত্র (Bhurjapatra) থেকে ভুজপাতা।

ভূর্জপত্রের বৈজ্ঞানিক নাম Melaleuca Cajuputi। এর হিন্দি নাম ভুজপত্র। সংস্কৃতে 'ভূজপত্রক'। হিন্দি ভুজপত্র বা সংস্কৃত ভুজপত্রক থেকে ভুজপাতা শব্দের উদ্ভব। কাগজ আবিষ্কারের পূর্বে ভারতবর্ষের হিমালয়সংলগ্ন অঞ্চলে ভুজপত্র বা ভুজপাতা লেখার কাগজ হিসেবে অত্যধিক জনপ্রিয় ছিল।


ভুজপত্র, প্রকৃতপক্ষে, কোনো পাতা নয়। এটি ভূর্জ গাছের ছাল। এই ছালকে রোদে শুকিয়ে তেল প্রভৃতির সাহায্যে নানা কৌশলে মসৃণ করে মেঝেতে পেতে পত্র, পুস্তক প্রভৃতি লেখা হতো। তাই নাম ভূজপত্রক, ভূর্জপত্র বা ভুজপত্র। বাংলায় যা ভুজপাতা।


"বুঝলে ভুজপাতা, না বুঝলে তেজপাতা" প্রবাদটির সাধারণ অর্থ— আপনি যদি বুঝে থাকেন বা আপনার জ্ঞান থাকে, তাহলে আপনি তুচ্ছ ছাল বা সামান্য জিনিসও মূল্যবান কাগজে পরিণত করতে পারেন। যাতে আপনি বই লিখতে পারেন এবং লেখা বই জ্ঞানের ভান্ডার হিসেবে যুগের পর যুগ সংরক্ষিত থাকবে। আর যদি না বোঝেন তাহলে পুস্তকের পাতাও রান্নায় ব্যবহৃত তেজপাতার মতো তুচ্ছ আবর্জনা হয়ে যায়। যা ফেলে দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এজন্য বলা হয়, "জীবনটা তেজপাতা হয়ে গেল।"


এর আলংকারিক বিস্তৃত অর্থ হলো- জ্ঞান বা জ্ঞানী তুচ্ছ বিষয়কেও মূল্যবান করে তুলতে পারে; অন্যদিকে, মূর্খতা বা মূর্খ মূল্যবান বিষয়কেও তুচ্ছ করে দিতে পারে। একজন বিচক্ষণ শিক্ষক তাঁর জ্ঞানের দ্বারা একজন সাধারণ মেধার শিক্ষার্থীকেও অসাধারণ মেধাবী বানিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু প্রজ্ঞার অভাব হলে অসাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থীও ওই শিক্ষকের কারণে সাধারণ হয়ে যেতে পারে।


একজন জ্ঞানী তাঁর সৃজনশীল প্রজ্ঞা দ্বারা গাছের সামান্য ছালকেও কাগজ-পুস্তক, মূল্যবান উপকরণ, যন্ত্র বা লেখসামগ্রী বানিয়ে কল্যাণকর বস্তুতে পরিণত করে দিতে পারে। অন্যদিকে, একজন অজ্ঞের কাছে জ্ঞানের ভান্ডার বা লেখসামগ্রী বা অতি মূল্যবান উপকরণ দিলেও তা গরম জলে ডোবালে আবর্জনা হয়ে যাওয়া বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তেজপাতার মতো অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়।


মূল লেখক: এম. এ. কবির এমএসসি

সূত্র: বাংলা ভাষার মজা, ড. মোহাম্মদ আমীন

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url